Home বানিজ্য অর্থসংকটে সরকার, সার-বিদ্যুতের দেনা মেটাতে বন্ড ছাড়ছে
জানুয়ারি ৩, ২০২৪

অর্থসংকটে সরকার, সার-বিদ্যুতের দেনা মেটাতে বন্ড ছাড়ছে

টাকার সংকটে পড়া সরকার সার ও বিদ্যুৎ খাতের দেনা মেটাতে বাজারে বন্ড ছাড়ছে। এই বন্ড কিনবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বিপরীতে সুদ পাবে তারা।

বন্ড হলো একধরনের আর্থিক পণ্য, যা বিক্রি করে সরকার ও বেসরকারি খাত দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নিতে পারে।

রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় সার ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির টাকা পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। তাই এবার বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি। সার ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ সরকারের দেনা প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দফায় বন্ড ছাড়া হবে সারের পাওনা পরিশোধ বাবদ। এ জন্য অর্থ বিভাগের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ কয়েক দিন থেকেই কাজ করছে। আর বিদ্যুতের বন্ড ছাড়া হবে পরের দফায়। সেটা হতে পারে ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে।

সরকারি হিসাবে সার ও বিদ্যুতে বেসরকারি খাত ও সরকারি সংস্থার পাওনা প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুতের ভর্তুকি ১৪ হাজার কোটি টাকা বকেয়া। সারে বকেয়া ১২ হাজার কোটি টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি ততটা ভালো নয়। তাই রাজস্ব আদায় কম। এ কারণে নগদ টাকায় ভর্তুকির দায় পরিশোধের বদলে বন্ড ছাড়তে হচ্ছে। কত বছর মেয়াদি বন্ড ছাড়া হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি।

দেশে মার্কিন ডলারের সংকটের কারণে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এতে আমদানি খাতে রাজস্ব আদায় কমেছে। স্থানীয় উৎস থেকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) আদায়েও গতি কম। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। এ সময়ে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা।

আর্থিক সংকটে থাকা সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া শুরু করেছিল। তবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সে পথ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরে এসেছে। এখন সরকার হাঁটছে বন্ড ছাড়ার পথে।

অর্থ বিভাগ আজ বুধবার বা আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যেই এই বিশেষ বন্ড ছেড়ে সার ও বিদ্যুৎ খাতে দায় মেটানোর প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। যদিও তা কার্যকর হতে আরও দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

আমদানিকারক ও উৎপাদকের কাছ থেকে যে দামে সার কেনা হয়, তার চেয়ে অনেক কম দামে বেচা হয় বাজারে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও তা–ই। মাঝখানের পার্থক্যটুকু ভর্তুকি দেয় সরকার। কয়েক মাস ধরে সার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকার পাওনা পরিশোধ করতে পারছিল না।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা ও সারে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে।

সারে ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ার কারণ বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) দেওয়ার কারণে এ খাতে সরকারের বিপুল ব্যয় করতে হচ্ছে।

সূত্র জানায়, বন্ড ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গত মাসে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে পাওনার তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে অর্থ বিভাগ। তাদের চিঠি পাওয়ার পর বিভাগটি গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওনা হিসাব করেছে ২৬ হাজার কোটি টাকা।

জানা গেছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর তা বিক্রি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে। এ উৎপাদনের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও ঋণের কারণে তারা ব্যাংকের কাছে দেনাদার থাকে। এদিকে বিপিডিবি যে দামে কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনে, তার চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি করে বাজারে। তবে কেনা দাম ও বাজার দামের পার্থক্য ভর্তুকি আকারে দেয় অর্থ বিভাগ।

অর্থ বিভাগ এ টাকা দিচ্ছিল না বলে কেন্দ্রগুলো ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে পারছিল না। ফলে তাদের অনেকেই ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছিল। টাকা দিতে না পারায় এখন অর্থ বিভাগ ব্যাংকগুলোকে সরাসরি বন্ড দিয়ে দিচ্ছে। ব্যাংকঋণের সমপরিমাণ অর্থের বন্ডই ছাড়বে অর্থ বিভাগ। সারের ক্ষেত্রেও একইভাবে বন্ড পাচ্ছে ব্যাংকগুলো।

যা বলেছিল বিসিআইসি

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) নভেম্বরের শেষ দিকে নিরবচ্ছিন্ন সার আমদানির ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের সহযোগিতা চায়। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিমকে এক চিঠিতে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান জানান, সার আমদানির ৩ হাজার ১৬৭ কোটি টাকার ঋণ হয়ে খেলাপি হয়ে গেছে এবং নতুন এলসি খোলায় জটিলতা হচ্ছে। গত জুন পর্যন্ত শুধু ইউরিয়া সারের ভর্তুকিই সরকারের কাছে পাওনা ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ভর্তুকির টাকা না পেলে ব্যাংকের দায় পরিশোধ করা যাবে না। তারল্যসংকটে অগ্রণী ব্যাংক এরই মধ্যে এলসি খুলতে অপারগতা প্রকাশ করেছে।

আরও বলা হয়, সৌদি আরব থেকে সার আমদানির মূল্য যথাসময়ে পরিশোধ করা হয়নি। এ কারণে সৌদি আরবের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। দেশটির একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে গেছে।

বন্ডের সুদের হার নিয়ে আলাপ চলছে। আমরা আশা করছি তা বাজার দরেই থাকবে। সরকার বন্ডের পথে গেল কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তা বলতে পারব না। তবে এটাও একটা বিকল্প, বিশ্বজুড়েই যার চর্চা রয়েছে।

মো. আফজাল করিম, এমডি, সোনালী ব্যাংক

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, ব্যাংকগুলো সরকারের বিশেষ বন্ডকে এসএলআর হিসেবে দেখাতে পারবে। ব্যাংকগুলোকে এসএলআর বাবদ যে অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়, এ বন্ডের অংশটুকু আর রাখতে হবে না। ফলে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা বাড়বে। তবে সোনালী ব্যাংকের মতো ব্যাংক এ সুবিধা নিতে পারবে না। কারণ, ব্যাংকটির এসএলআর বাবদ যে অর্থ রাখা দরকার, বর্তমানে তার চেয়ে বেশি টাকার বন্ড কেনা আছে।

সোনালী ব্যাংকের এমডি মো. আফজাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্ডের সুদের হার নিয়ে আলাপ চলছে। আমরা আশা করছি তা বাজার দরেই থাকবে।’ সরকার বন্ডের পথে গেল কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তা বলতে পারব না। তবে এটাও একটা বিকল্প, বিশ্বজুড়েই যার চর্চা রয়েছে।’

বিদ্যুতের পাওনা পরিশোধেও বন্ড

বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ)। সংগঠনটির সদস্য এখন ৬২। বিদ্যুতের মূল্য বাবদ সরকারের কাছে তাদের পাওনার বিপরীতে ব্যাংকগুলোর কাছে আবার তাদের দেনা আছে। যতটুকু দেনা আছে, তার বিপরীতে ছাড়া হবে বন্ড।

বিআইপিপিএর সাধারণ সম্পাদক ইমরান করিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পাওনা পাব না। তবে আমাদের দেনা শোধের একটা ব্যবস্থা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে প্রজ্ঞাপন হলেও অনেক কাজ বাকি আছে। প্রতিটি ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের কথা বলতে হবে।’

বর্তমান সরকারের আগের এক আমলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) দায়ের বিপরীতেও ব্যাংকের অনুকূলে বন্ড ছেড়েছিল অর্থ বিভাগ।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, যেটা হচ্ছে, তা হলো টাকা না ছাপিয়ে বন্ড ছাড়া হচ্ছে। তা–ও মন্দের ভালো। ব্যাংকগুলো আর পাওনা টাকা চাইবে না, বন্ডের বিপরীতে বরং তাদের কিছুটা আয় হবে। তবে এ উদ্যোগে ঠিকই সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ বাড়বে। তিনি বলেন, সংকটে না থাকলে সরকার এ পথে যেত না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *