Home বানিজ্য বন্ধ কোম্পানির শেয়ার কিনে সর্বস্বান্ত বিনিয়োগকারীরা
1 day ago

বন্ধ কোম্পানির শেয়ার কিনে সর্বস্বান্ত বিনিয়োগকারীরা

কোম্পানি বন্ধ দীর্ঘদিন হলো। সর্বশেষ বার্ষিক সাধারণ সভাও (এজিএম) হয়েছে কয়েক বছর আগে। এরমধ্যে কোনো কোম্পানি আবার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর শেয়ারহোল্ডারদের কখনোই নগদ লভ্যাংশ দেয়নি। উলটো বন্ধের আগে প্রতি বছর বোনাস শেয়ার ইস্যু করে মালিকপক্ষ তাদের শেয়ার বিক্রি করে আরও লাভবান হয়েছে।

অদ্ভুত শোনালেও সত্যি! দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের মূল মার্কেটে বন্ধ এসব কোম্পানির শেয়ার প্রতিদিন দেদার বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী, ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও অনেকটা নির্বিকার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই)।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোনো কোম্পানি সংস্কার করার জন্য বন্ধ রাখা যায়। এছাড়া, নির্দিষ্ট কোনো কারণেও বন্ধ থাকতে পারে। কিন্তু তা বছরের পর বছর কেন হবে?। তারা বলেন, দেখা যায়, হঠাৎ করেই এসব বন্ধ কোম্পানির বিষয়ে নানা ধরনের ‘প্রাইস সেনসেটিভ’ তথ্য প্রচার করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনায় আকৃষ্ট করে। পরে দেখা যায়, এসব কিছুই ভুয়া!। মধ্যখান থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় কারসাজি চক্র। পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, বন্ধ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করা আর জেনে-বুঝে বিষপান করা একই কথা। তিনি বলেন, এ বিষয়টা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চিন্তা করা উচিত। আইসিবি চেয়ারম্যান বলেন, কিছু মানুষ গুজব ছড়িয়ে বন্ধ কোম্পানি নিয়ে জুয়া খেলছে বলে তিনি জানান।

বন্ধ কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে ৭৫০ শতাংশ!

কারখানা বন্ধ থাকা একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ৭৫০ শতাংশ বেড়েছে। ভাবা যায়! অথচ এ ঘটনাটিই ঘটেছে খুলনা প্রিন্টিংঅ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের ক্ষেত্রে। গতকাল সোমবার সাত টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হওয়া কোম্পানির শেয়ারদর গত এক বছরের ব্যবধানে সাত টাকা থেকে ৫৯ টাকা ৫০ পয়সায় উঠে যায়।

গতকাল বন্ধ অ্যাপোলো ইস্পাতের ৩ লাখ ২ হাজার ৫১৪টি শেয়ার বিক্রি

বন্ধ থাকা অ্যাপোলো ইস্পাতের সর্বশেষ এজিএম হয়েছে ২০১৮ সালে। এ সময় থেকে কোম্পানিটি লোকসানে আছে। অথচ ২০১৩ সালে তালিকাভুক্তির সময় ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রিমিয়াম নেওয়া হয় ১২ টাকা। গত এক দশকের মধ্যে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে যথাক্রমে মাত্র ৩ ও ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। তবে ২০১৩ সালে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর পাঁচ বছর বোনাসের কারণে কোম্পানিটির শেয়ারসংখ্যা এখন ৪০ কোটি ১৩ লাখ ৮ হাজার ৬০০টি। এর প্রায় ৯ কোটির মতো শেয়ার আছে উদ্যোক্তাদের হাতে। এই হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর মালিকপক্ষ আরও ১৬ কোটি শেয়ার বিক্রি করেছে। অথচ বন্ধ থাকা কোম্পানিটির গতকাল ডিএসইর মূল মার্কেটে ৩ টাকা ৬০ পয়সা দরে ৩ লাখ ২ হাজার ৫১৪টি শেয়ার বিক্রি হয়েছে। শুধু গতকাল নয়, আগের কার্যদিবসগুলোতেও কোম্পানিটির শেয়ার নিয়মিত লেনদেন হয়েছে। এর আগে ২০২৩ সালের আগস্টে কোম্পানিটির বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে ছয় মাস সময় চেয়ে বিএসইসির কাছে আবেদন করেছে কর্তৃপক্ষ। সে সময় এই তথ্যে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে জানতে ডিএসইর ওয়েবসাইটে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোম্পানিটির সচিবের ফোন নম্বর দেওয়া নেই। সেখানে দেওয়া টিঅ্যান্ডটি নম্বরে যোগাযোগ করলে বলা হয়, আপনি ভুল নম্বরে ডায়াল করেছেন।

তুং হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড

টেক্সটাইল খাতের কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০১৪ সালে। কোম্পানিটি তালিকাভুক্তির পর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো নগদ লভ্যাংশ দেয়নি। ফেসভ্যালু ১০ টাকায় তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির শেয়ার গতকাল ডিএসইতে দুই টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হয়। এদিন কোম্পানিটির মোট ১ লাখ ২৮ হাজার ৭০৭টি শেয়ার লেনদেন হয়। দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ থাকলেও গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারদর দুই টাকা ৮০ পয়সা থেকে ছয় টাকা ২০ পয়সার মধ্যে ওঠানামা করে। কোম্পানিটির মোট ১০ কোটি ৬৬ লাখ ৫৩ হাজার শেয়ারের মধ্যে ৬২ দশমিক ৩৮ শতাংশই আছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে।

শুধু এ দুটি কোম্পানিই নয়, মূল মার্কেটে লেনদেন হওয়া উৎপাদন বন্ধ থাকা নর্দান জুট, নূরানী ডাইং, ইমারেল্ড ওয়েলে পাশাপাশি ওটিসি মার্কেটের বন্ধ ৩২টি কোম্পানি নিয়েও বিভিন্ন সময় কারসাজি হচ্ছে। এদিকে ডিএসইর ওয়েবসাইটে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিভিন্ন তথ্য থাকলেও ‘বন্ধের’ বিষয়টি দৃশ্যমান কোনো জায়গায় দেখা যায়নি। যা দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সচেতন হবেন।

বন্ধ থাকা এসব কোম্পানির বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে ডিএসই সূত্র জানায়, ডিএসই কীভাবে বুঝবে মূল মার্কেটের কোনো কোম্পানি বন্ধ আর কোনো কোম্পানি খোলা রয়েছে। কারণ, এজন্য তো নিয়মিত কোম্পানি পরিদর্শন করতে হবে। কিন্তু পরিদর্শনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারখানা পরিদর্শনে অনুমতি দিতে গড়িমসি করে। ডিএসইর পরিচালক রিচার্ড ডি’ রোজারিও এ প্রসঙ্গে ইত্তেফাককে বলেন, ইচ্ছা করলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ কোম্পানি তালিকাচ্যুত করতে পারে। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কথা চিন্তা করে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয় না। তবে রুগ্ন কোম্পানি-যার আর ফিরে আসার সুযোগ নেই তাকে তালিকাচ্যুত করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, উন্নত দেশে এক্সচেঞ্জ থেকে কোম্পানি তালিকাচ্যুতির বিষয়ে কঠোর আইন আছে। কোনো কোম্পানি তালিকাচ্যুত করা হলে পরবর্তী সময় সেই কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকরা যাতে আর কোনো কোম্পানির পরিচালক হতে না পারে সে ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ফলে কোম্পানির অবস্থা যেন খারাপ না হয়, সে ব্যাপারে উদ্যোক্তারা সচেতন থাকেন।

এ প্রসঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ইত্তেফাককে বলেন, কোম্পানির সংস্কার কাজের জন্য উৎপাদন বন্ধ রাখা যায়। আর সংস্কার ছাড়া ছয় মাসের বেশি সময় বন্ধ রাখলে কোম্পানিটিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নামিয়ে দেওয়া হয়। তবে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের কথা চিন্তা করে অনেক সময় তালিকাচ্যুতি করা হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে সব কোম্পানি ওটিসিতে আছে, সেগুলো তালিকাচ্যুত হয়েই সেখানে গেছে। পুঁজিবাজারের বিভিন্ন সমস্যা সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ প্রসঙ্গে টাস্কফোর্সের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ইত্তেফাককে বলেন, বিএসইসির বর্তমান কমিশন বাজার সংস্কার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। বন্ধ কোম্পানির বিষয়গুলো নিয়েও আমরা কাজ করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *