Home জাতীয় বিধি ভেঙে নিয়োগ, জেসিআইএলের সিই কে এই শহীদুল?
নভেম্বর ২৪, ২০২৪

বিধি ভেঙে নিয়োগ, জেসিআইএলের সিই কে এই শহীদুল?

বিধি লঙ্ঘন করে প্রায় ৪ বছরে আগে সরকারি মার্চেন্ট ব্যাংক ‘জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি.’র বর্তমান সিই (চিফ এক্সিকিউটিভ) শহীদুল হককে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার আমলেই বেক্সিমকো শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে ৪৭৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় এই প্রতিষ্ঠানকে।

নিজের আত্মীয় এই সিই নিয়োগ দিতে বিধিবিধান এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত তোয়াক্কা করেননি জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. এসএম মাহফুজুর রহমান। তিনি (মাহফুজুর রহমান) নিজেও সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো এবং এস আলমকে ঋণের নামে একচেটিয়া লুটপাটের সুযোগ করে দিয়ে জনতা ব্যাংককে পঙ্গু করে দিয়েছেন। বিতরণ করা ঋণের ৬১ শতাংশই এখন খেলাপি।

জনতা ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি হচ্ছে জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি. (জেসিআইএল)। এই কোম্পানির সব স্তরের লোকবল নিয়োগ কর্তৃপক্ষ জনতা ব্যাংকের পর্ষদ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং জনতা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেসিআইএলের সিই (চিফ এক্সিকিউটিভ) পদে নিয়োগের জন্য ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। প্রার্থীর যোগ্যতা হিসাবে চাওয়া হয় ৩-৪ বছরের স্নাতকসহ ইকনোমিক / ফাইন্যান্স / ব্যাংকিং / অ্যাকাউন্টিং / ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর এবং সঙ্গে এফসিএ / এফসিএমএ / এফসিসিএ।

এছাড়া অন্যান্য শর্তের মধ্যে পেশাগত অভিজ্ঞতা সর্বনিম্ন ১৫ বছর, এর মধ্যে মার্চেন্ট ব্যাংকের অভিজ্ঞতা ৫ বছর এবং বয়স হতে হবে ৪৫-৫৫ বছরের মধ্যে। এছাড়া নিয়োগবিধি অনুযায়ী কোনো পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণি থাকলে তা অযোগ্যতা হিসাবে বিবেচিত হবে।

জনতা ব্যাংকের ২০২০ সালের ৬৩৭তম পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেসিআইএলের সিই নিয়োগের জন্য শহীদুল হকসহ তিনজন প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকেন তৎকালীন নিয়োগসংক্রান্ত কমিটি। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এসএম মাহফুজুর রহমান।

কমিটির সদস্য ছিলেন-ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য অজিত কুমার পাল (পরিচালক), অধ্যাপক স্বপন কুমার বালা প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি এবং জনতা ব্যাংকের সাবেক এমডি আব্দুস ছালাম আজাদ ছিলেন আহ্বায়ক। আরও জানা গেছে, পর্ষদের নিয়োগসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের নথি কমিটির বৈঠকে উত্থাপন করা হয়।

সেখানে প্রথম সুপারিশ ছিল মোহাম্মদ আলী নামের এক প্রার্থী। তার প্রসঙ্গে বলা হয় ‘বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী-পেশাগত যোগ্যতা, বয়স ও অভিজ্ঞতা যথাযথ রয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের অভিজ্ঞতাও যথাযথ রয়েছে। তবে বিকম (সম্মান) এর স্থলে বিকম (পাশ)। দ্বিতীয় প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া প্রসঙ্গে সুপারিশে উল্লেখ করা হয় ‘বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী-পেশাগত যোগ্যতা, বয়স ও অভিজ্ঞতা যথাযথ রয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের অভিজ্ঞতাও যথাযথ রয়েছে। তবে স্নাতকত্তোর ডিগ্রি নেই এবং বিকম (সম্মান) এর স্থলে বিকম (পাশ)।

আর সর্বশেষ সুপারিশ করা হয়েছিল শহীদুল হক প্রসঙ্গে। সেখানে বলা হয়, ‘বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পেশাগত যোগ্যতা যথাযথ রয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। তবে বয়স কম ও মোট ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। বিকম (সম্মান) এর স্থলে বিকম (পাশ) এবং বিকম (পাশ) এর তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জনতা ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী তিনজন প্রার্থীর মধ্যে কেউ নিয়োগের যোগ্য নন। আবার তিনজন প্রার্থীর মধ্যে তুলনামূলক কমযোগ্য প্রার্থী ছিলেন বর্তমান সিই শহীদুল হক। কিন্তু সব বিধান ভেঙে সিই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল শহীদুল হককে।

তবে নিজের যোগ্যতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা কম-এমন প্রশ্ন অস্বীকার করেছেন জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সিই শহীদুল হক। তিনি বৃহস্পতিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘অভিযোগ সঠিক নয়। সব নিয়ম মেনেই আমার নিয়োগ হয়েছে। ইন্টারভিউ, স্কুটিং ও সব ধরনের বিধান অনুসরণ করেই সেটি হয়েছে। প্রয়োজনে অনুসন্ধান করে দেখতে পারে সরকার।’

তবে শর্ত ভেঙে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি জেসিআইএলের সিই নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি তদন্ত করছে জনতা ব্যাংকের হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট। অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগের বিষয়টি এর আগে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানে কাছে লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারক মঙ্গলবার যুগান্তরকে জানান, বিষয়টি আমি প্রথম জানতে পারলাম। শর্ত ভেঙে জনতা ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট লি. সিইর নিয়োগ দিতে পারে না ব্যাংকের বোর্ড। এটি যদি বোর্ড দিয়ে থাকে এবং এ ধরনের ঘটনা ঘটে আমি বিষয়টি অবশ্যই দেখব। এ বিষয়ে আমি খোঁজ নেব।

বিধান ভেঙে জেসিআইএলের সিই নিয়োগের বিষয়ে জনতে চাইলে জনতা ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান মুহ: ফজলুর রহমান যুগান্তরকে জানান, বিষয়টি খুবই প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ, আমি পদক্ষেপ নিতে চাই। এখন সহযোগিতা পেলে অবশ্যই সেটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ বিষয়ে সহযোগিতার ব্যাপারে আমি স্বাগত জানাব।

জানা গেছে, শহীদুল হককে ২০২০ সালের শেষদিকে নিয়োগ দেওয়া হয় জনতা ক্যাপিটাল ইনভেস্ট লি.র সিই হিসাবে। এর পরের ২ বছর অর্থাৎ ২০২১ এবং ২০২২ সালে বেক্সিমকো শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে ৪৭৭ কোটি মুনাফা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে জনতা ক্যৗাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে বেক্সিমকোর শেয়ার কারসাজির জন্য। সম্প্রতি এ ঘটনা উদ্ঘাটনের পর জড়িত চার ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪২৮ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

তবে জনতা ব্যাংকের হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের জিএম (জেনারেল ম্যানেজার) আব্দুল মতিন যুগান্তরকে জানান, শহীদুল হকের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ তদন্ত চলছে। তবে জনতা ব্যাংকে বিধিবিধানে স্বাভাবিক বা চুক্তিভিত্তিক যে কোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণির ডিগ্রিপ্রাপ্ত গ্রহণযোগ্য নয়। পরিচালনা পর্ষদের বোর্ড অনুমোদন দিতে পারে তবে সেটি কি কারণে দেবে বোর্ড অবশ্যই জানে। স্বাভাবিক বিধানে তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য নয়।

সূত্রমতে, অর্থ উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগপত্রে এ প্রসঙ্গে বলা হয়, তৎকালীন সিই হিসাবে শহীদুল হককে নিয়োগের জন্য গঠিত সাক্ষাৎকার কমিটির ৫ জন সদস্যের মধ্যে ২ জন এক্সটার্নাল সদস্য যথেষ্ট বিরোধিতার পরেও ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও এমডি এ বিতর্কিত নিয়োগ সম্পন্ন করেন।

শুরুতে এ নিয়োগ ১ বছর মেয়াদি হওয়ার কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে পরে ২ বছর করা হয়। দাপ্তরিক কাজকর্মের যথাযথ দক্ষতার ঘাটতি ও পুঁজিবাজার সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানের অভাব থাকার পরেও এ মেয়াদকাল শেষ হওয়ার পরে বেতন-বোনাস ও অন্যান্য সুবিধাদি ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিয়ে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ পরবর্তী ৩ বছরের জন্য বৃদ্ধি করা হয়।

ওই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, সরকারি মালিকানাধীন আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লি., আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লি., আইসিবি সিকিউরিটিজ লি., অগ্রণী ইক্যুইটি অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি., রূপালী ইনভেস্টমেন্ট লি. ও রূপালী ব্যাংক সিকিউরিটিজ লি.-এ কোনো চুক্তিভিত্তিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নেই। তথাপি এসব প্রতিষ্ঠান সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে। ব্যাংকসহ এর সাবসিডিয়ারি কোম্পানিগুলোতে চুক্তিভিত্তিক অচিরেই বন্ধ না হলে বেশিরভাগ সময় অযোগ্য ও নিম্ন মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিরা সুযোগ বুঝে এসব ‘লোভনীয়’ পদে ঢুকে পড়েন। প্রকৃত পক্ষে, চুক্তিভিত্তিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হোক বা না হোক তাতে এসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার তেমন কোনো হেরফের হয় না।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, জনতা ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জনতা ক্যাপিট্যাল ইনভেস্টমেন্টের সিইও বর্তমান বেতন তুলনামূলক জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) চেয়ে বেশি, যা যুক্তিসংগত নয়। এটি সংশোধন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

সূত্রমতে, শিক্ষাগত যোগ্যতা বিকম (পাশ) তৃতীয় বিভাগ প্রাপ্ত হলেও জনতা ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্টর বর্তমান সিই সরকারের কাছ থেকে বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা জনতা ব্যাংকের একজন জিএম কর্মকর্তার সমান। বেতন-ভাতা, বোনাস মিলে এই সিই মাসিক আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন পৌনে চার লাখ টাকার বেশি। ২০২৩ সালের হিসাবে বেতন বাবদ গ্রহণ করেছেন প্রায় ২৪ লাখ টাকা, ভাতা নিয়েছে প্রায় ১৮ লাখ টাকা এবং দুটি বোনাস চার লাখ টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *