‘বাংলাদেশ বৈষম্যহীন হলেই কেবল ছেলের রক্তদান সার্থক হবে’
বৈষম্য বিরোধী মানসিকতা নিয়েই বেড়ে উঠছিলেন জুলকার নাইন। তিনি ঢাকার আশুলিয়া পলাশবাড়ী জেএল মডেল স্কুলের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। কারো অধীনে যেন না থাকতে হয় সে জন্যে কখনও চাকুরি করবেন না, এ কথা বলতেন এই যোদ্ধা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা।
কোটা সংস্কার থেকে শুরু করে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত ৫ আগস্ট আশুলিয়া বাইপাইলে শহিদ হন তিনি।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, জুলকার নাইন (১৭) ঢাকার আশুলিয়া পলাশবাড়ী জেএল মডেল স্কুলের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি পাবনা সাথিয়া উপজেলার নন্দনপুর ইউনিয়নের স্বরূপ গ্রামের মো. আব্দুল হাই আল হাদির ছেলে। পিতা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। মা গৃহিণী মোছা. হালিমা খাতুন। তিন সন্তানের মধ্যে জুলকার নাইন ছিলেন দ্বিতীয়। বড় বোন তৌহপা এবং ছোটভাই হামজা (৬) কে নিয়ে ছিল তাদের সুখের সংসার। তারা সকলে আশুলিয়ার বাইপাইলে বসবাস করতেন।
নিজের আগ্রহেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিতেন জুলকার নাইন। তিনি নবীনগর, জাহাঙ্গীর নগর, আশুলিয়ায় বেশ কয়েকদিন আন্দোলনে যোগ দেন। গত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বেলা তিনটার দিকে আশুলিয়ায় আনন্দ মিছিল বের হলে সে মিছিলেও যোগ দেন জুলকার নাইন। ওইদিন বেলা সাড়ে ৪টার দিকে পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। সরাসরি বুকে গুলি লাগে। ক্রিকেট খেলোয়াড় জুলকার নাইন গুলি খেয়েও দাঁড়িয়ে ছিলেন। আহত জুলকার নাইনকে উদ্ধার করে আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে এনাম হাসপাতালে পাঠানো হয়। সাভারের এনাম হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শহিদ জুলকার নাইনের বাবা মো.আব্দুল হাই আল হাদি বলেন, আমার ছেলে জুলকার নাইন স্বাধীনচেতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। অধীনতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য ব্যবসা করবে বলে ইচ্ছে পোষন করত। ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক ছিল প্রবল। কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না। নিজের আগ্রহেই নবীনগর, জাহাঙ্গীরনগর, বাইপাইল, আশুলিয়ায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেয়। নিষেধ করলেও মানত না। বলত, সাইদ, মুগ্ধদের মতো প্রয়োজনে আমিও শহিদ হবো। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বেলা তিনটার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে আশুলিয়ায় আনন্দ মিছিলে যোগ দেয়।
আনন্দ মিছিলে অনেকেই গুলিতে নিহত এবং আহত হয়। বেলা সাড়ে ৪টার দিকে বাইপাইলে আমার ছেলেও গুলিতে আহত হয়। গুলি খেয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। রাস্তায় ঢলে পড়ে। পরে আন্দোলনকারীরা আহত জুলকার নাইনকে উদ্ধার করে আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি করে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে অক্সিজেন দিয়ে এনাম মেডিকেলে পাঠানো হয়। সাভারের এনাম হাসপাতালে নিয়ে গেলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে এনাম হাপাতালে যাই। আমি আমার সন্তানকে জীবিত দেখতে পারিনি। এনাম হাসপাতাল থেকে প্রথমে বাসায় পরে রাতেই পাবনার সাথিঁয়ায় নিজ বাড়িতে নিয়ে আসি। গত ৬ আগস্ট বেলা ১০ টায় জোড়গাছা কবরস্থানে দাফন করি।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, যাদের গেছে তারাই বুঝতেছে কি গেছে। কোন সহযোগিতা এখনও পাই নাই। আমরা কোন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না। আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়ে গেল। আমি চাই দেশের জন্য যারা জীবন দিয়ে গেছে তাদেরকে শহীদি মর্যাদা দেয়া হোক। প্রয়োজনে ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ক্যাটাগরি ভাগ করে জাতীয় বীর হিসেবে ভূষিত করা হোক। একটি আদর্শ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে উঠলে আমার ছেলের জীবনদান সার্থক হবে।
আমরা রাষ্ট্রের কাছে কিছু প্রত্যাশা করি না। কেবল এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হোক এটাই চাই।