শূন্য থেকে সফল সাবিকার মাসিক আয় ৪৫ হাজার
উচ্চশিক্ষা নিয়েও অনেক নারী চাকরি করার ফুরসত পান না। পড়াশোনা শেষ করে তারা সংসার সামলান। ফলে চাকরি করে স্বাবলম্বী হওয়ার যে স্বপ্ন সেটা অধরাই থেকে যায়। কিন্তু কিছু কিছু নারী আছেন যারা অদম্য। স্বামী, সংসার, সন্তানদের দেখভাল করেও তারা ঘরে বসেই স্বাবলম্বী হতে চান। মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজের চেষ্টায় হয়ে ওঠেন অনুকরণীয়। তাদেরই একজন মাহমুদা ইয়াসমিন সাবিকা। যিনি ঘরে তৈরি করা খাবার অনলাইনে বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। পঁচিশ পার হওয়া এ নারী এখন এলাকায় অনেকেরই আদর্শ।
বগুড়া সদর উপজেলার দত্তবাড়ি এলাকার মেয়ে মাহমুদা ইয়াসমিন সাবিকা। দুই ভাইবোনের মধ্যে ছোট সাবিকা ২০১৩ সালে এসএসসি পাশ করেন নিজ এলাকার কাটনার সেন্ট্রাল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। পড়াশোনার এক পর্যায়ে অনার্স ৩য় বর্ষে থাকাকালীন ২০১৮ সালে পছন্দের এক বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। কর্মহীন ছেলেকে বিয়ে করায় মেনে নেয়নি সাবিকার পরিবার।
স্বামীর বেকারত্ব আর সাংসারিক খরচ মেটাতে না পেরে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান পড়াশোনা জানা এ নারী। কোনো উপায় না পেয়ে শখের বসে খাবারের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যবসার ইচ্ছা জাগে তার। বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে খাবারের প্রচার শুরু করে দেন তিনি। হঠাৎ একদিন সবজি শিঙাড়ার অর্ডার পেয়ে যান সাবিকা। গোপনে মায়ের কাছ থেকে ধার নেওয়া ৪০০ টাকা দিয়ে শুরু করেন শিঙাড়া তৈরির কাজ। দ্রুত সময়ে রুচিসম্মত এ খাবারটি ডেলিভারি দিয়ে প্রশংসিত হন ক্রেতার কাছ থেকে। সাবিকার এ ব্যবসার প্রচার যখন এলাকার মানুষের কাছে পৌঁছাতে থাকে তখন নিজ পরিবার, আত্মীয়স্বজনসহ প্রতিবেশীরা বিষয়টি ভিন্ন চোখে দেখত। সাহস জোগানোর পরিবর্তে কটূক্তি করতে থাকে প্রায় সবাই। বেকার স্বামীর অনুপ্রেরণায় এ সময় দুজনে মিলে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন তারা। এক সময় সাবিকার এ ব্যবসার লভ্যাংশ থেকে চলতে থাকে তাদের দুজনের সংসার।
খাবারের ওপর টিএমএসএস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করা শখের ব্যবসার জন্য প্রথমে নয় হাজার ও পরে ৫০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান পান এ নারী উদ্যোক্তা। ক্রমান্বয়ে তার ব্যবসার এমন সফলতায় পরিবারসহ সবাই খুশি। এর মধ্যে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে সমাজ কর্মের ওপর মাস্টার্স পাশ করেন সাবিকা। নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে খোলেন ফেসবুক পেজ। সেখানে চলতে থাকে তার ব্যবসার চাকা। কাস্টমাইজ দেশি খাবার, পোলাও, বিরিয়ানি, খিচুড়ি প্যাকেজ, বিভিন্ন স্ন্যাকস আইটেম, ডেজার্ট আইটেম, শীতের পিঠা, গরুর মাংসের আচারসহ প্রায় ৩০ ধরনের খাবার নিয়ে কাজ করছেন সাবিকা। তার এ ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন ৬ সহযোগী। তারাও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। শূন্য থেকে উঠে আসা শিক্ষিত এ নারী উদ্যোক্তা এখন প্রতি মাসে আয় করছেন প্রায় অর্ধ লাখ টাকা। হোমমেড খাবার তৈরি করে এবং যথাসময়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিয়ে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন সাবিকা। বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করে অর্জন করেছেন সম্মাননা। খাবারের ওপর প্রায় ৮-১০টি প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে ঘরে বসেই ব্যবসা করছেন। মেয়ের এমন সাফল্যে গর্বিত বাবা নাসিমুল গনি। মেনে নিয়েছেন তাদের বিয়ে।
মাহমুদা ইয়াসমিন সাবিকা বলেন, ‘এত বছরের ব্যবসায় ব্যর্থতা যেমন ছিল সফলতাও তেমন পেয়েছি। তবে অন্য ১০ জন নারীর মতো বিয়ের পর বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা নিতে পারিনি আমি। প্রথমে অভাবের সংসার ও পরে স্বাবলম্বী না হতে পারার কারণে এ স্বপ্নকে পিছিয়ে দিতে হয়েছে। কেননা ব্যবসার প্রথম দিকে পরিবারসহ প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি বাধা এবং হতাশামূলক কথা। সামাজিকভাবে প্রথম পর্যায়ে নারী হয়ে এমন কাজ কখনো ভালো চোখে দেখেনি কেউ। কিন্তু বর্তমানে পারিবারিক সব বাধা পেরিয়ে সামাজিকভাবেও অনেক সম্মান পাচ্ছি। ব্যবসাটা শুরু করি মাত্র ৪০০ টাকা দিয়ে। অথচ গত ছয় বছরে এত ভালো বিক্রি হবে তা ভাবিনি। এ পর্যন্ত রিপিট কাস্টমার পেয়েছি হাজারের বেশি। তবে বিজনেসটা শুরু করেছিলাম একটা স্বপ্ন থেকে শখের বশেই। প্রথম যেদিন নিজ হাতে বানানো খাবার কাস্টমারের হাতে পৌঁছে দিই, সে অনুভূতিটা ছিল অসাধারণ। কাস্টমারের কাছ থেকে পাওয়া ফিডব্যাক ছিল কাজের প্রতি অনেক বড় অনুপ্রেরণা। আগে বাবার পরিচয়ে বড় হয়েছি, এখন নিজের পরিচয়ে সমাজে আরও বড় হতে চাই।’