এখনও স্বাভাবিক হয়নি সংসদ সচিবালয়ের কার্যক্রম
এখনও স্বাভাবিক হয়নি সংসদ সচিবালয়ের কার্যক্রম। গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতা গণভবন ও সংসদ ভবনের ভেতরেও প্রবেশ করে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এরপর আত্মগোপনে চলে যান সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। গত ২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন তিনি।
এর আগে ১৫ আগস্ট ওই সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুকে রাজধানীর একটি বাসা থেকে আটক করেন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ১৪ আগস্ট সংসদ সচিবালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব কেএম আবদুস সালামের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তার জায়গায় নতুন সচিব হিসেবে ড. মো. আনোয়ার উল্লাহকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
সূত্রের খবর, স্পিকারের পদ থেকে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর পদত্যাগ, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুকে আটকের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন সচিব নিয়োগ সত্ত্বেও সংসদ সচিবালয়ের কার্যক্রম কার্যত এখনও স্বাভাবিক হয়নি। সেখানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, দলাদলি, মুখোমুখি অবস্থান এবং অনেকের রাতারতি বোল পাল্টানোর ফলে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে সংসদ সচিবালয়ের কার্যক্রম।
সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনামলে প্রশাসনের অন্যান্য জায়গার মতো সংসদ সচিবালয়ও ছিল আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সুবিধাজনক পোস্টিং, আবাসন সুবিধা গ্রহণসহ নানা অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন তারা। রাজনৈতিক পালাবদলের পর সংসদ সচিবালয়ে কর্মরত বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি তালিকা করা হয়।
যদিও এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, এদের মধ্যে যারা বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত এবং গত ১৫ বছরের সুবিধাভোগী। কোনো নির্বাচন ছাড়াই অনির্বাচিত একটি কমিটি গঠন করে তারাই বর্তমান সচিবের আনুকূল্য পাওয়ার আশায় প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কেউ কেউ নিজেদের বিএনপিপন্থী পরিচয় দিয়ে ইতোমধ্যে সংসদ সচিবালয়ে অধিভুক্ত বিভিন্ন ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি শুরু করেছেন। এছাড়াও সংসদ সচিবালয়ে কর্মরত অনেক নিরীহ কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক তকমা দিয়ে, কোনো অভিযোগ ছাড়াই বদলি কার্যক্রম শুরু করেছে।
জানা গেছে, কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে সংসদ সচিবালয়ে কর্মরত বিভিন্ন কর্মচারীদের তালিকা তৈরি করছে। এরপর এ তালিকা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দিয়ে যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়াই তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। আবার দুর্নীতিবাজদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তাদের বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংসদ সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, নিরীহ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অহেতুক বদলি, হয়রানি করার ফলে সংসদ সচিবালয়ে ক্ষোভ এবং অসন্তোষ বিরাজ করছে। যেকোনো সময় একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
ওই কর্মকর্তার মতে, যারা গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ছিল এবং ক্ষমতার পালাবদলের পর রাতারাতি বোল পালটে বিএনপি সেজে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মাচারীদের হুমকি দিচ্ছেন, হয়রানি করছেন। এতে করে বিএনপিপন্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে ১২ জন আত্মীয়কৃত কর্মকর্তা কর্মচারীকে ওএসডি করার পর বর্তমানে গণ হারে বদলি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রায় ১২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী সংসদ সচিবালয়ে কর্মরত। তাদের বসিয়ে না রেখে অন্য যেকোনো কাজে লাগানোর বিষয়টাও সামনে আসতে পারে। কেননা কেবলমাত্র হিসাব শাখা, বাজেট শাখা, মানব সম্পদ শাখা, প্রশাসন শাখা, কমন শাখা ছাড়া অন্য কোনো শাখায় এই মুহুর্তে কাজ নেই। প্রায় ৫৬ কমিটি রয়েছে সংসদ সচিবালয়ে। এই কমিটিগুলোরও কার্যক্রম নেই। কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মাচারী আছে। যারা বসে বসে বেতন নিচ্ছেন। আর নিজেরা দলাদলি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।
যদিও গত ৫ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবনে ভাঙচুরের ঘটনায় সরকারি ও ব্যক্তিগত তহবিলসহ প্রায় ৯০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর সংসদ ভবনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা সভায় এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়। সভায় দুর্ঘটনাপরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় তুলে ধরা হয়। এই ক্ষত এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি সংসদ সচিবালয়।
ওই সভায় সংসদ ভবন, সংসদ সদস্য ভবন (মানিক মিয়া ও নাখাল পাড়া), পুরাতন এমপি হোস্টেল, মন্ত্রী হোস্টেল, সচিব হোস্টেল ও সংসদ ভবন আবাসিক এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার এবং ওইসব এলাকার ভাঙা, হারানো ও ক্ষতিগ্রস্ত মালামাল পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ক্ষতিগ্রস্ত ও স্তূপীকৃত মালামাল সরেজমিন পরিদর্শন করে শপথকক্ষে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়াও জাতীয় সংসদ ভবনে ক্ষতিগ্রস্ত কম্পিউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ইন্টারনেট সংযোগ, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, লাইন ও সেটসমূহ জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এখনো এ কাজে খুব একটা সফলতা আসেনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলাদলির কারণে।