কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে দেশের রক্তক্ষয়ী এই সংকট থেকে উত্তরনের পথ কি?
বালী তাইফুর রহমান তূর্য, সমাজকর্মী ও লেখক।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন ধীরে ধীরেই ক্রমশ গভীর সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হয়তো।সরকারের নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের চাটুকারদের অদূরদর্শী চিন্তার পরামর্শেই হোক বা অন্য যেকোনো কারনেই হোক,শিক্ষার্থীদের উপর দমন পীড়ন নীতি দেশকে এক গভীর অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে।এমনিতেই বাজারে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি জনমনে নেতিবাচক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে,এর সাথে এই
আন্দোল যুক্ত হলে পরিস্থিতি ভিন্ন ধরনের হতে পারে।
রাস্ট্রীয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সামরিক বাহিনীর হাতের বৈধ অস্ত্রের বুলেটে দেশের নিরস্ত্র ছাত্রদের এবং সাধারণ মানুষের বুকে বিধে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার দিক বোঝা দ্বায়।জনতার পালস বুঝতে না পারা,জিদের বশবর্তী হয়ে ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালানো এবং গন গ্রেফতারের সিদ্ধান্তটি নি:স্বন্দেহে একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো।
আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশের আগ্রাসী হিংস্র ভুমিকা এবং তাদের অপেশাদার আক্রমণের হিংস্রতার দৃশ্য এবং গন গ্রেফতারে অতি উৎসাহি মনোভাব ১৯৭১ সালের পাক হানাদার বাহিনীর থেকে কোনো অংশে কম নয় বলেই অভিমত দিয়েছেন অনেকে।সহিংসতা ঠেকানোর নামে তাদের দমন, পীড়ন,নির্যাতনের চিত্র যেকোনো পাশবিক উদাহরণকে হার মানায়।অথচ তাদেরও মস্তিষ্ক রয়েছে,শিক্ষাগত সনদ রয়েছে,পরিবার রয়েছে এবং উর্দিহীন অবসরপ্রাপ্ত জীবন রয়েছে।যখন তাদেরকে এই অভিষাপ বয়ে বেরাতে হবে।শিশু,কিশোর এবং পথচারীদের উপর তাদের নির্বিচারে গুলি চালানো এবং গ্রেফতারে হায়েনা সদৃশ আক্রমণগুলো মোটেই পেশাদার আচরণ ছিলো না বলেই বলছেন অনেকে।
রাজনৈতিক বিরোধী দলের ক্ষমতা দখলের নেশা এবং ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইয়ে হাতিয়ার হিসেবে আচরণ করছে রাস্ট্রীয় বাহিনী, যা এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না।রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াইতে দুই বড় দলের শীর্ষ নেতারা বা তাদের সন্তানদের কেউই গুলিবিদ্ধ হননি,গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন সাধারণ ছাত্র এবং খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ।
দেশের ছাত্রসমাজের সিংহভাগ ক্ষমতাসীন দলের মতের বিরুদ্ধে চলে গেছে,নাকি ক্ষমতাসীনরা ছাত্রদের বিরুদ্ধে চলে গেছে সেটিও একটি প্রশ্ন।বিরোধী দল দমনের চর্চায় যখন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেও সমান সূত্র প্রয়োগ করা হয়েছে তখন তা বুমেরাং হয়ে গেছে।সব কিছু দমন করতে নেই,দমিয়ে রাখাও যায় না।ক্রোধের আগুন অনেক সময় নিজেকেও ছাই করে দেয়।
যেকোনো গন আন্দোলনে বিরোধী দলের ক্ষমতা দখলের বা ফয়দা লোটার পুরনো সংস্কৃতিটাও এখানে অতি পুরনো বিধায় সংকট বেশি গভীর।এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে যখন ক্ষমতার পালা বদল হয়েছিল তখনও কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সমর্থন দিয়েছিলো ততকালীন ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ এরাও তখন মানুষের জন জীবন বিষিয়ে তুলেছিলো।যদি ঘুরে ফের ক্ষমতা তাদের হাতেই যায়,তাহলে সেই সংঘাত এবং অরাজকতাও হয়তো ফিরে আসবে ফের।আবার ক্ষমতাসীনরা বাজার নিয়ন্ত্রণ, অর্থনীতি সহ বিভিন্ন ভাবে চড়ম নিয়ন্ত্রণহীন এবং ব্যর্থ বলেই দেখা দিয়েছে।তারা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দ্বায় অস্বীকার করতে পারে না,এর সাথে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি,অর্থ পাচার,ব্যাংক লুটপাটের মতো অভিযোগ।অর্থাৎ এই দুই বড় দলেই আসলে দেশের বিপদ।
অনেকের মতে এই সংকটের মুহূর্তে দরকার ছিল তৃতীয় শক্তি বা দল,যা স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও গড়ে ওঠেনি বা উঠতে দেয়া হয়নি।রাজনৈতিক ভাবে এই দেশে মূলত দল দুটো ভাগে বিভক্ত, একটি আওয়ামী লীগ এবং অপরটি এন্টি আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগ বিরোধী।অর্থাৎ একটি জোট আওয়ামী পন্থী আরেকটি দল আওয়ামী বিরোধী।কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর বাইরে দেশের ক্ষমতায় ছিলো হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সেনা শাসন এবং তার জাতীয় পার্টির শাসন।অথচ তারা নিজেদেরকে সেভাবে সক্ষম করে তুলতে পারেনি।যদিও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলের প্রশংসা করেন অধিকাংশ সাধারণ বয়স্ক নাগরিকরা।এরশাদের আমলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিলো যা অস্বীকার করা যায় না।পক্ষান্তরে ইসলামি বেশ কিছু দল থাকলেও তারাও এই আলাদা দুই ঐক্যে বিভক্তিতে রয়েছে।এছাড়া যেই দলগুলো ধর্মভিত্তিক এবং পৃথক মতের তাদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য নেই বলে তারাও দুর্বল।
তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়,এই গভীর সংকটের উত্তরনের পথ কোথায়?সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে সকল নিরপরাধ ছাত্র ও নির্দোষ সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেয়া?
আওয়ামী লীগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দলটি তার প্রতিষ্ঠালগ্নের দর্শন থেকে প্রকৃতপক্ষে অনেকটা সড়ে এসেছে এখন।যেমন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন প্রখ্যাত আলেম।একজন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যিনি নিজ পরিচয়েই স্বরনীয় এবং অন্যজন মাওলানা আ:রশিদ তর্কবাগীশ। তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিতীয় সভাপতি ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আশির দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অবধি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর মাওলানা তর্কবাগীশকে স্বপরিবারে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মোশতাক সরকার তাদের নিজ রচিত স্টেটমেন্ট প্রকাশ করেন। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশই প্রথম নেতা যিনি আওয়ামীলীগের নেতা কর্মী সমেত শেখ মুজিবুর রহমানের কবর জিয়ারত করেন ততকালিন সরকারের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে।যাদেরকে এখন আর এই দল মনে করে না।আলেমদের সাথেও দলটির আর সখ্যতা নেই ২০১৩ সালের মতিঝিলের হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই।
দলটিতে থাকতে পারেননি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মতো নেতাও যিনি প্রকাশ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছিলেন।এবং সেজন্য তাকে নির্বাসিতও হতে হয়েছিলো।১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাঘা সিদ্দিকী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক, যিনি ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য ব্যতিরেকেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে ঢাকা আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন।১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বপরিবারে নিহত হলে এর প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তিনি কাদেরিয়া বাহিনী পুণর্গঠন করে সিমান্ত এলাকায় যুদ্ধ চালিয়ে যান।তার সাথে যোগ দেন নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত ওসমান পরিবারের নাসিম ওসমান ও চটগ্রামে সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন। ১৯৯০ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত অনেকেই থাকতে পারেনি দলটিতে এর মধ্যে আরও রয়েছেন সংবিধান প্রনেতা ড.কামাল হোসেন,তাজউদ্দীন আহমেদের ছেলে সোহেল তাজের মতো লোক।ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী যাকে শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত স্নেহ করতেন,তার সমাজতন্ত্রের অনেক বিষয় প্রশংসা করতেন সেই জাফরুল্লাহ চৌধুরীকেও যথাযথ সম্মান দেখাতে পারেনি দলটি।পক্ষান্তরে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরে ট্যাংকের উপরে উঠে উন্মাদ নৃত্য করা হাসানুল হক ইনু কিংবা তার চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চাওয়া মতিয়া চৌধুরীদের যায়গা হয়েছিলো আওয়ামী লীগের মন্ত্রী সভায়।
২০০৯ সালের পর থেকেই দলটি টানা ক্ষমতায় থাকলেও এর অভ্যন্তরে ক্ষোভ জমেছে তৃণমূল কর্মীদের।বিরোধী দলে থাকাকালীন নির্যাতিত অনেক নেতা কর্মীরাই রয়ে গেছেন অবহেলিত।হাইব্রিডদের প্রভাবে অভিমানেই নীরবে সরে গেছেন অনেক বিশ্বস্ত নেতা কর্মী।দেশের তৃণমূল পর্যায়েও কেন্দ্রীয় নেতাদের বলয় তৈরি, টেন্ডার বানিজ্য,অনুপ্রবেশকারীদের সুবিধা প্রদান,মনোনয়ন বানিজ্যের মাধ্যমে অযোগ্যদের স্থান দিয়ে প্রকৃত জনপ্রিয় এবং ত্যাগী কর্মীরা নিষ্পেষিত হতেই থেকেছেন।যারা এক সময় আওয়ামী লীগের কর্মীদের নির্যাতন করেছেন,তারাই যখন সেই দলের নেতৃত্ব দেন,জয় বাংলা স্লোগান দেন তখন অভিমানেই নীরবে অবহেলিত হয়েছেন হাজারো বিশ্বস্ত কর্মী।সেই দ্বায়ও দলটি এড়াতে পারে না, যারফলে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে দলের নেতারা,বুঝতে পারেন না সাধারণ মানুষের পালস।
বিএনপির শাসনামলেও সন্ত্রাস,দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।আরও বড় অভিযোগ এই দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব পদে আসীন তারেক রহমানের আচরণ নিয়ে।দলটির অনেক সিনিয়র নেতাই তার উগ্র এবং অপেশাদার আচরণ সহ্য করতে না পেরে দল ছেড়ে দিয়েছিলেন।তিনি তার সেই আচরণের পরিবর্তন এনে নিজেকে পিতার যায়গায় গ্রহনযোগ্য করতে পারবেন?তার দলের ছাত্র সংগঠন কি সন্ত্রাস চাদাবাজি থেকে মুক্ত থাকতে পারবে?
অনেকে হয়তো ভাবেন,সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ে নিলে সংকট কিছুটা কাটতে পারে।কিন্তু আস্থার সংকট বেড়েছে তাদের নিয়েও।প্রশ্ন উঠছে তাদের সচ্ছতা নিয়েও,কিভাবে সারা বিশ্বে শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করা সৈনিক নিজের দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে বন্দুক তাক করে থাকে সামরিক সাজোয়া যানবাহন নিয়ে।মানুষের শেষ আস্থার যায়গা থাকে সেনাবাহিনী, তারাও যদি নিজেদের বিবেক দিয়ে ভালো মন্দ বিচার না করেই আজ্ঞাবহ দাসের মতো গুলি চালায় তাহলে সেই পাকিস্তানি মিলিটারি আর এদেশের সৈনিকের তফাৎটা কোথায়?এছাড়াও আরও গভীর প্রশ্ন থেকে যায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিলেও এক সময় নির্বাচন দিতেই হবে,তখন যে ফলাফল হতে পারে সেটি নিয়েও অনেকেই সহিংসতার আশংকা করেছেন।
কারফিউ দিয়ে সব বন্ধ করে দেয়া যায়,কিন্তু পেটের ক্ষুধাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।কারফিউ দিলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ উপার্জন করতে পারে না,তারা খাবে কি,আর ঋণের কিস্তি দেবে কি দিয়ে?বাজারের দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি এমনিতেই বিষিয়ে তুলছে জীবন, কারফিউ আর আন্দোলনে তো গরীবের মহা বিপদ। সে বিপদ দেখার যেনো কেউ নেই।
শেষ প্রশ্ন থেকেই যায়,এই সংকটের উত্তরনের পথ কি?
সব শেষে একটিই কথা থাকে,দেশটা শান্ত থাকুক,ভালো থাকুক,রক্ত না ঝড়ুক,আর একটা লাশ না পরুক।