নেতা-মন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল করে বানান ভুয়া সুপারিশপত্র
দলের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতাদের নাম অপব্যবহার করে ভয়াবহ প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেছেন রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল আসাদ রাসেল। নেতাদের নাম বিক্রি করে কামিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
পরিচয় দেন প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার হিসাবে। টাকার বিনিময়ে চাকরি বা পদ দিতে নিজেই তৈরি করেন ভুয়া সুপারিশপত্র। জাল করেন সরকারের মন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের স্বাক্ষর। দলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতনের অহরহ অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার এসব অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে যান ‘তদবিরবাজ প্রতারক’। ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রভাবশালী দু-একজন নেতার আশীর্বাদ পেয়েই এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন রাসলে।
প্রভাবশালী মন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার পরিচয়ে চলেন রাসেল : চাকরি দেওয়ার কথা বলে বরগুনার তালতলী উপজেলার মনুখেপাড়া গ্রামের ওয়াওয়েনসে মারমার (সুমা) কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়েছিলেন মাহমুদুল আসাদ রাসেল। ওয়াওয়েনসে মারমার মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার রোলে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই টাকা নিয়েছিলেন তিনি।
রির ব্যবস্থা করতে না পারলেও সাড়ে তিন লাখ টাকা আর ফেরত দেননি রাসেল। বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী নারী আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ দিয়েছিলেন। তবে বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত সুবিচার পাননি তিনি। বরং উলটো ভুক্তভোগী নারীকে চাকরি খাওয়ার হুমকি দেন রাসেল।
তিনি যেন আর টাকা না চান, সেজন্য নানাভাবে দেখান ভয়ভীতি। এ বিষয়ে ওয়াওয়েনসে মারমা যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। অন্যের থেকে ধার করে টাকা দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম মেয়েটার চাকরি হলে সংসার ভালো চলবে। কিন্তু চাকরি হয়নি, টাকাও ফেরত পাইনি। এখন ব্যাংক থেকে টাকা লোন নিয়ে ধার পরিশোধ করতে হচ্ছে। আমি টাকা ফেরত চাই।’
রাসলে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর নাম বিক্রি করে চলেন অভিযোগ করে ওয়াওয়েনসে মারমা বলেন, ‘তিনি নিজেকে পরিচয় দেন ওই মন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার হিসাবে। এগুলো মানুষকে বিশ্বাস করাতে মন্ত্রীর সঙ্গে থাকা ছবি উপস্থাপন করেন। কখনো কখনো তৈরি করেন তার ভুয়া সুপারিশপত্র। এগুলো দেখিয়ে চাকরি দেওয়ার অফার করেন। এরপর সুবিধা অনুযায়ী টাকা নেন এবং তা আর ফেরত দেন না।’
তিনি বলেন, ‘একজন মানুষ সব সময় মন্ত্রীর আশপাশে থাকেন। ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেন। নিজেকে মন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার হিসাবে পরিচয় দেন। এমন দেখে আমি বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছিলাম। পড়ে শুনেছি মন্ত্রীর সুপারিশ ভুয়া। তিনি নাকি নিজেই মন্ত্রীর সই জাল করেন। এমন একজন প্রতারক কীভাবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে থাকেন। আওয়ামী লীগের মতো দলে পদ পান?’
আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের পদ বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের মনোনয়ন ম্যানেজ করে দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে রাসেলের বিরুদ্ধে।
তৃণমূলে থেকে আসা কর্মীদের মারধর : আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আসেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এসব নেতাকর্মীকে মারধর করার অভিযোগ রয়েছে রাসেলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের। বিষয়গুলো নিয়ে বেশ কজন ভুক্তভোগী আওয়ামী লীগ সভাপতি বরাবার লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন।
অসৌজন্যমূলক আচরণ, কিলঘুসি ও পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফেলায় রাসেলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সদস্য শহিদুল্লাহ রাজিব। অভিযোগে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ও তিন চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমি আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মী। ২০২৩ সালের ২৫ মার্চ রাসেল অহেতুক আমাকে মারধর করেন। তিনি আক্রমণ করে আমার পরিহিত কাপড় ছিঁড়ে ফেলেন। তার অপরাধের জন্য আমি আপনার (আওয়ামী লীগ সভাপতি) কাছে সুবিচার কামনা করি।’
রাসেলের বিরুদ্ধে দলীয় প্রধানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরফকিরা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাফরুল ইসলাম। ওই অভিযোগে তিনি বলেন, ‘আমি ইউনিয়ন পর্যায়ের একজন কর্মী। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু মাহমুদুল আসাদ রাসেল আমাকে কিলঘুসি মারেন। আমার সঙ্গে থাকা ব্যক্তিদেরও মারধর করেন। পার্টি অফিস থেকে বের হওয়ার পর রাসেলের বাহিনীর লোকজন আমাদের ওপর আবার আক্রমণ করেন।’
কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতাকে মারধর করার অভিযোগ রয়েছে রাসেলের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ওই নেতাকে মারধর করেন তিনি। শুধু মারধর নয়, বিভিন্ন সময়ে পার্টি অফিসে আগত নেতাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচারণ, পার্টি অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন তিনি।
রাজকীয় জীবনযাপন : রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হলেও ঢাকায় থাকেন মাহমুদুল আসাদ রাসেল। সারা দিন আওয়ামী লীগ অফিসে প্রভাবশালী নেতাদের প্রটোকল দেওয়াই তার একমাত্র কাজ। যদিও ঢাকায় তার দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। কোথাও চাকরি করেন কি না, তাও জানে না কেউ। তবুও ঢাকায় রাজকীয় জীবনযাপন করেন তিনি। চলেন নিজের গাড়িতে। ঢাকায় কিনেছেন ফ্ল্যাট। সরেজমিন রাসেলের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের সাঙ্গুড়া গ্রামে গিয়েও তার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়।
অভিযোগ রয়েছে, একসময় ছাত্রদল করা রাসেল আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার নাম অপব্যবহার করে এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানীতে একটি বাড়ি দখলের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগ বিষয়ে রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল আসাদ রাসেল যুগান্তরকে বলেন, চাকরি দেওয়া কথা বলে টাকা নিয়েছি, এমন অভিযোগ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এই অভিযোগের সত্যতা নেই। তৃণমূল থেকে আগত নেতাকর্মীদের মারধরের অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমি যতদূর জানি এ বিষয়ে দলের সভাপতি বরাবর কোনো অভিযোগ পড়েনি। তিনি আরও বলেন, আমাদের কাপড়ের ব্যবসা আছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাই। এ উপার্জন দিয়ে আমাদের সংসার চলে।