নিঃসন্তান দম্পতিরা অসহায়, ব্যয়বহুল সেবা নিতে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে
বন্ধ্যত্বের সমস্যার সম্মুখীন নিঃসন্তান দম্পতিদের জন্য সর্বাধুনিক চিকিৎসা হলো-‘ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’ বা আইভিএফ পদ্ধতি। দেশে দুই যুগের বেশি আগে এই চিকিৎসা চালু হলেও সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিধি বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এর দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য বিভাগ একরকম হাতগুটিয়েই বসে আছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এর উপযুক্ত চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকায় সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন দেশের অসংখ্য অসহায় নিঃসন্তান দম্পতি। কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে তারা বেসরকারি হাসপাতাল ও বিদেশের হাসপাতালের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এভাবে ব্যয়বহুল এই সেবা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সন্তান ধারণের চেষ্টার পর টানা এক বছর কেউ সফল হতে না পারলে তাকে ইনফার্টাইল বা সন্তান ধারণে অক্ষম হিসাবে গণ্য করা হয়। নিঃসন্তান দম্পতিদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্ত্রী ও একই সংখ্যক স্বামীদের শারীরিক নানা সমস্যা থাকে। ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে দুজনেরই সমস্যা থাকে। বাকি ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে সমস্যা অজানাই রয়ে যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আর্থসামাজিক ও জনমিতি জরিপ ২০২৩ অনুযায়ী দেশের ৬৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী বিবাহিত। বিশেষজ্ঞদের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী বিবাহিতদের মধ্যে বর্তমানে বন্ধ্যত্বের হার ২০ শতাংশের উপরে। যদিও নিঃসন্তান দম্পতিদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। দিন যত যাচ্ছে এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দেশে ৩৭টি সরকারি ও ৬৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। এছাড়াও প্রায় ছয় হাজার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। যেখানে প্রজনন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত চিকিৎসাব্যবস্থা কমবেশি থাকলেও নিঃসন্তান দম্পতিদের জন্য আইভিএফ চিকিৎসাসেবা একেবারেই অপ্রতুল। শুধুমাত্র রাজধানীর কয়েকটি বড় বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ইনফার্টিলিটি বিভাগ রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে ৪০ জনের মতো বিশেষজ্ঞ আছেন। এশিয়া ইনিশিয়েটিভ প্যাসিফিক অন রিপ্রোডাকশনের তথ্য বলছে, চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল চিকিৎসাব্যবস্থা, সীমাহীন ভোগান্তি আর আস্থার সংকটে ভুক্তভোগীরা বিদেশে ছুটছেন। সেখানে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি টাকা খরচ করছেন। এতে সহজেই চলে যাচ্ছে দেশের অর্থ। জানা গেছে, দেশে বেসরকারি সেন্টারভেদে আইভিএফ চিকিৎসা নিতে খরচ হয় গড়ে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। কিন্তু এ পদ্ধতিতে যাওয়ার আগেই ভুল পথে হেঁটে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়ে একেক দম্পতির দুই লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়ে যায়। সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় জনবল ও আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা না থাকায় ব্যয় অপেক্ষাকৃত কম হলেও সফলতার হার কম। দেশে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা সাধারণত তিন ধাপে দেওয়া হয়। প্রথমত; মেডিকেশন বা প্রাইমারি, এ ধাপে হরমোনাল ইনজেকশন ও ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে গর্ভধারণের চেষ্টা করা হয়। দ্বিতীয় ধাপ হলো-ইন্ট্রা ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন (আইইউআই), এ প্রক্রিয়ায় ল্যাপরোস্কোপিক সার্জারির মাধ্যমে ওভারিয়ান ব্রিডিং করানো হয়। আইইউআই পদ্ধতিতে স্বামীর বীর্যে শুক্রাণুর পরিমাণ কম বা নিষ্ক্রিয় থাকলে শুক্রাণু সংগ্রহ করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় করে স্ত্রীর গর্ভে স্থাপন করা হয়।
টারশিয়ারি বা তৃতীয় ধাপ হলো-বন্ধ্যাত্বের সর্বাধুনিক চিকিৎসা আইভিএফ। বন্ধ্যাত্ব নিয়েও নারীর মাতৃত্বের বাসনা পূর্ণ করার সুযোগ রয়েছে আইভিএফের মাধ্যমে। এটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও সহজ পদ্ধতি। অনেকে আইভিএফকে টেস্টটিউব পদ্ধতি বলে থাকেন। আইভিএফ মাধ্যমে স্বামী থেকে নেওয়া শুক্রাণুর সঙ্গে ল্যাবরেটরিতে ডিম্বাণুর ফার্টিলাইজেশন করা হয় ও উপযুক্ত সময়ে সেটি স্ত্রীর গর্ভে স্থাপন করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ১৯৯৮ সাল থেকে আইভিএফ সেবা শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ এ সেবার কলেবর বাড়াতে পারছে না। আইভিএফ চিকিৎসায় ২০টি সেন্টার স্থাপিত হলেও সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সেন্টার মাত্র তিনটি। সরকারিভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল স্থাপিত আইভিএফ সেন্টারের মাধ্যমে মাত্র একটি শিশু আলোর মুখ দেখতে সক্ষম হয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলতে ঢামেকের আইভিএফ সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ডা. ফাতেমা পারভিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ব্যস্ততার অজুহাতে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইভিএফ সেন্টার চালু হলেও মাত্র একজন নারীর গর্ভধারণের খবর নিশ্চিত করেছে। তবে সফলতার ক্ষেত্রে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল এক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে। বন্ধ্যা দম্পতিদের চিকিৎসায় সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে রাজধানীতে পাঁচটি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। এগুলো হলো-মোহাম্মদপুর ইনফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার, আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, মিরপুরে (লালকুঠি) মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (মাতুয়াইল) এবং শামসুননেছা আরজু মনি মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র (হাজারীবাগ)। তবে এগুলোর কোনোটিতেই আইভিএফ চিকিৎসাসেবা নেই। বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলছেন, দেশে ২০২২ সালে ২০টি সেন্টারে প্রায় চার হাজার দম্পতি এ পদ্ধতি গ্রহণ করায় প্রায় এক হাজার ৩০০ জন বাবা-মা হয়েছেন। যাদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান লাভের সুযোগ ছিল না।
ভ্রুণতত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ ফার্টিলিটি হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এসএম খালিদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দেশে অন্তত ১০ লাখ দম্পতি তথা ২০ লাখ নারী পুরুষের আইভিএফ পদ্ধতির প্রয়োজন। বর্তমানে দেশে ১০০ জনকে আইভিএফ চিকিৎসা দেওয়া হলে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ সফল গর্ভধারণ হচ্ছে। গত দুই বছরে আমাদের হাসপাতালে আইভিএফ চিকিৎসা নিয়ে ৫০০ বেশি নারী গর্ভধারণ করেছেন, যেটা বাংলাদেশে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি আরও বলেন, সরকারি ল্যাবের সংখ্যা ও সেন্টার বাড়ানো গেলে সহজেই চিকিৎসা নিয়ে সন্তানের মুখ দেখার সুযোগ পেত। এজন্য স্বাস্থ্য বিভাগের আরও বেশি হস্তক্ষেপ দরকার।