বসবাসের জন্য কোনটিকে শ্রেয় মনে করেন, গ্রাম নাকি শহর?
বালী তাইফুর রহমান তূর্য, সমাজকর্মী ও লেখক, নলছিটি।।
সাধারণত শহর বলতে ইট কাঠ আর পাথরের একটা প্রানহীন ঘামের নগরীকেই বুঝি।এখানে সবাই ব্যস্ত,কেই কারও খবর রাখার সময় পায় না।এখানে একাকী সময় কাটাতে একটা গল্প করারও লোক পাওয়া যায় না। নগরী মানেই যেনো কোলাহল, গাড়ির হর্নের শব্দ দূষণ, সব কিছুতেই ভেজাল আর বিষ।
পক্ষান্তরে গ্রাম বলতেই মানুষ বোঝে বা ধারণায় আসে একটা বিশাল সবুজের গালিচা।চারদিকে নির্মল হাওয়া,পানি,পাখি আর মুক্ত আকাশ।বুক ভরা নিশ্বাস,রাতের আকাশে এক ফালি চাঁদ এইই গ্রাম।গ্রাম মানেই চায়ের দোকানে সন্ধ্যা হলেই লোকে লোকারণ্য, কৃষকের খেতের নির্ভেজাল ফসল আর প্রাকৃতিক স্বাদের গরুর খাটি দুধ।দেশী হাস বা মুরগির ডিমের ভাজি দিয়ে পান্তা ভাতের সকাল।এক কাপ চায়ের সাথে যদি একটা পত্রিকা মেলে তবে একটা নির্মল শীতল হাওয়ার সাথে সকালের সূর্যোদয়।গ্রাম মানেই আষাঢ় মাসের ঝুম বৃষ্টি, কাদায় মাখামাখি পথ ঘাট,টিনের চালের বৃষ্টির ছন্দ।
আর তাই সারাটি জীবন শহরে কাটিয়ে অনেকেই অবসরে ফিরতে চান শৈশবের স্মৃতি মাখা গ্রামে।জীবনের শেষ সময়টি কাটাতে চান বাবা মায়ের সাথে অথবা বাবা মায়ের কবরের পাশে।বৃদ্ধ বয়সে যেনো মৃত বাবা মা আর শৈশবের স্মৃতির মতো মধুর সময় আর হয় না।
কিন্তু এই একই বস্তুর উল্টো পিঠও রয়েছ।যারা গ্রামেই বসবাস করেন কিংবা সহসাই গ্রামে যাতায়াত আছে তাদের কিন্তু গ্রামের সম্পর্কে রয়েছে ব্যাপক নেতিবাচক অভিজ্ঞতা এবং এগুলোর বাস্তব প্রমানও রয়েছে।
ঝালকাঠির সন্তান বিশিষ্ট কলামিস্ট এবং জীবনানন্দ গবেষক আমীন আল রশীদ তার এক অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন –
গ্রাম বনাম শহর:
গ্রাম সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণাগুলো খুবই ত্রুটিপূর্ণ। আমরা যারা শহরে জন্মগ্রহণ করেছি, শহরে বেড়ে উঠেছি এবং এখনও শহরেই থাকি, তারা মনে করি, গ্রাম হচ্ছে ছায়া সুনিবিড়ি শান্তির নীড়। মানুষে মানুষে ভালোবাসার বন্ধন। সবকিছু সস্তায় পাওয়া যায়। ইত্যাদি ইত্যাদি।…
কিন্তু এই ধারণাগুলো খুবই ত্রুটিপূর্ণ। বস্তুত শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ বেশি ক্রিটিক্যাল। এর কারণ, এখানে কোনো আড়াল নেই। সবাই সবার খবর রাখে। সবাই সবার ব্যাপারে নাক গলায়। কার মেয়েটা বড় হলো কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না। কার ছেলে শর্ট প্যান্ট পরে রাস্তায় বের হয়। কার বউ জোরে কথা বলে। কার বাড়ির হেঁশেল থেকে গরুর মাংসের গন্ধ আসছে অথচ ‘দাওয়াত পাইলাম না’। অমুকের পোলায় সরকারি চাকরি পাইছে ‘তো কী হইছে, খাইবে তো ঘুষ’। অমুক লোক অবসরে গেছে। এখন তো অনেক টাকা পাবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু শহর হচ্ছে একটা দেয়াল। এখানে যে কেউ চাইলে নিজেকে আড়াল করতে পারে। অন্যের ব্যাপারে নাক না গলিয়েও বসবাস করা যায়। ফলে শহরে কনফ্লিক্ট কম।
শহরের অধিকাংশ মানুষই যেহেতু ভাড়াটিয়া, ফলে পরস্পরের সঙ্গে বৈষয়িক বিষয় নিয়ে বিরোধ কম। কিন্তু গ্রামে প্রতিটি পরিবারেই জমিজমা, গাছপালা, কমন পুুকুর ও স্পেস নিয়ে কোনো না কোনো ঝামেলা আছে।
বরিশাল বিএম কলেজে আমার এক প্রিয় শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পরে কলেজের পেছনেই একটুকরো জমি কিনে অবসরের টাকা দিয়ে সেখানে একটি বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন। অনেক বছর পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা বরগুনার খুব প্রভাবশালী ও বিত্তশালী পরিবার। অবসরের পরে গ্রামে বাপের জমিদারিতে আপনি খুবই সম্মানের সাথে বসবাস করতে পারতেন। সেটা না করে শহরে এই ছোট্ট বাড়িতে কেন থাকছেন? স্যার বললেন, ‘গ্রাম সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নাই।’…
এর কয়েক বছর পরে অবসরে যান আমার শিক্ষক পিতা। আমরা শহরে ভাড়া বাসায় থাকতাম। কিন্তু অবসরের পরে আব্বার ইচ্ছা হলো গ্রামে গিয়ে তাঁর বাবার (আমার দাদা) কবরের পাশে থাকবেন। অবসরের টাকা দিয়ে সেখানে একটি বানালেন। কিন্তু বাড়িতে ওঠার তিন মাসের মধ্যে তিনি বললেন, ‘গ্রামে আসা ভুল হয়েছে। এখানে থাকা যায় না।’
এছাড়াও ঢাকায় বসবাসরত একজন সরকারি কর্মকর্তা জনাব আ:রহমানও জানিয়েছেন তার গ্রামের মানুষ কিভাবে তার বাড়িতে থাকা লোকজনের সাথে কূট চালে বিরক্ত করে তোলে।তার গ্রামের বাড়িতেও কেউ না থাকায় দুষ্ট ছেলেরা গাছের নারিকেল,আম কাঠাল সব চুরি করে নিয়ে যায়।পাশের বাড়ির প্রতিবেশীরাও শত সুবিধা ভোগ করার পরেও সুযোগ পেলেই অকৃতজ্ঞতার উত্তম উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়।শুধু মৃত পিতার কবরের মায়ায় এখনো ছেড়ে যাচ্ছেন না গ্রাম।
আবার বিপরীত অভিজ্ঞতাও বৈচিত্রময় উপস্থাপন করেছেন সমাজকর্মী বালী তূর্য। তিনি জানান,ঢাকায় পড়ালেখা করে বেশ কিছুদিন শহরে চাকরি করলেও মায়ের টানে ফিরে এসেছেন গ্রামে।নিজের উন্নত ক্যারিয়ার গড়ার বারবার সুযোগ আর ডাক পেয়েও ফিরতে চাননা শহুরে জীবনে।তার মতে গ্রামের মানুষের কিছু বাজে কর্ম থাকলেও গ্রামে অনেক অসহায় মানুষের বসবাস, এদের অধিকাংশই বিভিন্নভাবে উন্নয়ন বঞ্চিত।তাদের অভাব আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিভিন্ন সময় পরেছেন প্রভাবশালীদের রোশানলে,হেনস্থাও হয়েছেন বহুবার।তবুও যখন তিনি নিজের বাড়ির পুকুর আর সবুজ ঘাসের দিকে তাকান তখনকার নির্মল হাওয়ার নিশ্বাস,মায়ের এক ঝলক দর্শন তার ক্লান্তিকে দূর করে দেয়।
ভালো আর মন্দ সব কিছু মিলিয়েই বাংলাদেশের প্রকৃতি আর আমাদের জীবন।তবুও আশা,শহরগুলো সবুজ হোক,গ্রামগুলিও বসবাসের উপযোগী হোক।