অটিজম ও আধুনিক চিকিৎসা
এটির পুরো নাম অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার। অটিজম একটি অত্যন্ত পরিবর্তনশীল, নিউরোডোপোভমেন্টাল ডিসঅর্ডার যা বয়স তিন বছর হওয়ার পূর্বেই প্রকাশ পায়। অটিজম শিশুরা সামাজিক আচরণে দুর্বল হয়, পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কম সক্ষম হয়। মানসিক সীমাবদ্ধতা ও একই কাজ বারবার করার প্রবণতা থেকে এদের শনাক্ত করা যায়।
গত ২ এপ্রিল ছিল Autism Awareness Day। এই রোগের কারণ সর্ম্পকে এখনও কোনও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে জেনেটিক কারণে এটি হয় বলে প্রমাণ আছে। অটিজম জিনগত এবং পরিবেশগত কারণগুলোর সংমিশ্রণের সাথে জড়িত, গর্ভাবস্থাকালীন ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে রুবেলা, ভ্যালপ্রাইক অ্যাসিড, অ্যালকোহল, কোকেন, কীটনাশক, সীসা এবং বায়ু দূষণ, ভ্রূণের বৃদ্ধির সীমাবদ্ধতা এবং অটোইমিউন রোগের মতো কিছু নির্দিষ্ট সংক্রমণ রয়েছে। অনেকে এর কারণ হিসেবে পারিপার্শ্বিক ঝুঁকির (যেমন: টিকা নেবার কুফল এর) কথা বললেও কোনও গবেষণায় এর প্রমাণ পাওয়া যায় না।
এক থেকে দুই বছর বয়সে শিশুর আচরণে এ রোগের লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকে। অভিভাবকরাই সাধারণত প্রথমে এ রোগের লক্ষণ বুঝতে শুরু করেন। লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া জরুরি। রোগ নির্ণয়ে মূলত শিশুর সম্পূর্ণ আচরণের ইতিহাস এবং স্নায়ুতাত্ত্বিক গণণার হিসাব বিবেচনা করা হয়। আক্রান্ত শিশুর পরিচর্যা করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আচরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আক্রান্তের পরিচর্যা বা এপ্লায়িড বিহেভিয়ার এন্যালিসিসের সাহায্যে আক্রান্তের চিকিৎসা করাই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য এবং কার্যকরী। অটিজমের মাত্রা অত্যাধিক বেশি হলে রোগীদের স্বাধীন জীবনযাপনের সম্ভাবনা খুব কম থাকে তবে কম মাত্রার রোগীদের বেলায় এ ক্ষেত্রে পূর্ণ বয়সে সফলতা আসার সম্ভাবনা বেশি। তবে এ রোগের ক্ষেত্রে একে জীবনযাপনের একটি বিশেষত্ব মনে করে চিকিৎসা করাই ভাল।
অটিজমের প্রকাশ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন হারে ঘটে। আধুনিক গবেষণা মতে, প্রতি হাজারে ১ থেকে ২ জন অটিজম রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বিশেষ করে ১৯৮০ সালের পর থেকে আক্রান্ত হয়েছে জানা গেছে এমন রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। তবে এর পিছনে উন্নত রোগ নির্ণয় পদ্ধতি এবং সচেতনতা বৃদ্ধিই মূল কারণ বলে বিবেচিত হয়।
অটিস্টিক শিশুরা অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে বা আকাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে অক্ষম হতে পারে। নির্দিষ্ট বয়সে স্বাভাবিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও পরবর্তীকালে তা হারিয়ে যেতে পারে। আবার নির্দিষ্ট সময় থেকে দেরিতেও সাধারণ ব্যবহারগুলোর দেখা যেতে পারে। এই ডেভেলপমেণ্টাল বিলম্বতার মাত্রা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সকল চিকিৎসকেরা একই সিদ্ধান্তে নাও আসতে পারেন।
অটিজমের লক্ষণঃ
কিছু কথা বারবার বলা, কোনও কিছু ছোটখাটো জিনিসের জন্য প্রচণ্ড চিৎকার করে কাঁদা, এবং প্রশ্নকর্তার চোখের দিকে না তাকিয়ে কথা বলা, ব্যথা/শারীরিক আঘাতের সীমিত বোধ, বেশি আলো সহ্য করতে না পারা, লোকজনের তীব্র হুল্লোড়ে অস্বস্তি, কোনও জিনিস নিচু থেকে তোলার সময়ে অসুবিধা, মুখের পেশীর উপর নিয়ন্ত্রণহীনতা, মুখভঙ্গিমা নিয়ন্ত্রণে অপারগতা, প্রচণ্ড মেজাজ দেখানো ইত্যাদি।
অটিজম শিশুরা সারাক্ষণ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সদা সর্বদা কল্পনার এক অবাস্তব জগতে ডুবে থাকে তারা। নানা রকমের কাল্পনিক শব্দ শোনে, কাল্পনিক দৃশ্য দেখে। কিছু বিষয়কে তারা খুবই পছন্দ করে এবং দিনরাত সেগুলো নিয়েই পড়ে থাকে। আবার কিছু বিষয়কে তারা ভয় পায়, সহ্য করতে পারে না। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের বিচার-বুদ্ধির কোন উন্নতি হয় না। অটিজম মস্তিষ্কের আকৃতি সাধারণের চেয়ে বড় হয়ে থাকে, তবে এর প্রভাব সম্বন্ধে এখনও সঠিক কিছু জানা যায়নি।
ব্যাপকতাঃ
সবচেয়ে প্রচলিত মতামত অনুসারে নতুন জন্মগ্রহণকারী প্রতি ১০,০০০ জীবিত শিশুর মধ্যে ৪.৫ জন অটিজমে আক্রান্ত হয়ে থাকে। অবশ্য এটি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পরিচালিত জরিপের ফলে প্রাপ্ত একটি পরিসংখ্যান। বর্তমানকালের পরিসাংখ্যিক গবেষণার ভিত্তিতে মোট জনসংখ্যা ০ .২৫% থেকে ০ .৫০% পর্যন্ত এ ধরনের রোগে আক্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
আবিষ্কার ও গবেষণার ইতিহাসঃ
১৯৪০-এর দশকে ডঃ হ্যান্স অ্যাসপারগার প্রথম অটিজম সম্পর্কিত একটি রোগের কথা প্রথম উল্লেখ করেন যা অ্যাসপারগারের লক্ষণ নামে পরিচিত।
ইংরেজি Autism শব্দের পারিভাষিক প্রতিশব্দ আত্মসংবৃতি। Autism শব্দটি প্রথম ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত হয়। এটি প্রথম ব্যবহার করেন সুইস মনঃচিকিৎসক অয়গেন ব্লয়লার (Eugen Bleuler)। তিনি American Journal of Insanity তে প্রকাশিত তার একটি নিবন্ধে অস্বাভাবিক রকম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। এটি গ্রিক শব্দ αυτος (আউতোস্ অর্থাৎ “আত্ম”, “নিজ”) থেকে এসেছে। ব্লয়লার একান্তভাবে ভগ্নমনস্ক (Schizophrenic) মানুষ, যারা অন্য লোকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে না তাদের বোঝাতে এই শব্দের প্রচলন করেন। বর্তমান পরিভাষায় ভগ্নমনস্কতা সম্পূর্ণ আলাদা রোগ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এদের পৃথক করা কঠিন হতে পারে।
তবে অটিজমের চিকিৎসা শাস্ত্রগত শ্রেণিবিন্যাস ১৯৪৩ সালের আগে হয়নি। ১৯৪৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোরে অবস্থিত জন হপকিন্স হাসাপাতালের মনঃচিকিৎসক ডঃ লিও ক্যানার সর্বপ্রথম ১১টি মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত শিশুর আক্রমণাত্মক ব্যবহারের সামঞ্জস্যতা লক্ষ করে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন করেন এবং এ ধরনের ব্যাধির নাম দেন “early infantile autism”। শিশুরা অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন বা যোগাযোগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, এই রোগটিকে তিনি অটিজ্ম নামে চিহ্নিত করেন। এ বিষয়ে তার প্রথম প্রবন্ধ The Nervous Child নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল। তার বর্ণনার অনেক কিছুই এখনো অটিজম শিশুদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োগ করা হয়।
প্রায় একই সময়ে অস্ট্রিয় বিজ্ঞানী ডঃ হ্যান্স অ্যাসপারগার একই ধরনের পর্যবেক্ষণ করেন। তবে তার পর্যবেক্ষণটি বেশ উঁচুমাত্রার এবং একটু অন্য ধরনের বৈশিষ্ট্যাবলীর জন্য প্রয়োগ করা হয়। এই বিষয়টির নাম অ্যাসপারগারের লক্ষণ বা Asperger’s syndrome। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার প্রবন্ধগুলো ইংরেজিতে অনূদিত না হওয়ার কারণে তার পর্যবেক্ষণগুলো অনেকদিন কোন স্বীকৃতি পায়নি। ১৯৯৭ সালে তার প্রবন্ধগুলো স্বীকৃতি পায় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
চিকিৎসাঃ
অভিজ্ঞ রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের মতে রোগীলিপি তৈরি করে শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ নির্ণয় করে সুনির্বাচিত ঔষধ প্রয়োগে চিকিৎসা করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। তবে মানসিক অবস্থার উপর বিবেচনার মাধ্যমে উপযুক্ত চিকিৎসায় আরোগ্য সম্ভব।
লেখক: অটিজম গবেষক