Home স্বাস্থ্য সংবাদ সারা দেশে হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ রোগী
এপ্রিল ২৩, ২০২৪

সারা দেশে হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ রোগী

প্রচণ্ড গরমে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। সর্দি, কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, হিট স্ট্রোকসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগে ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এতে সারা দেশে হাসপাতালগুলোতে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ রোগী। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, সববয়সের মানুষের কষ্ট হলেও এই গরমে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন কিডনি, ক্যানসার, লিভার ও হার্টের রোগী এবং শিশু ও বয়স্করা। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর প্রায় ৭০ শতাংশই তারাই। তাই গরমে সুস্থ থাকতে অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না যাওয়া, সুতি কাপড় পরা এবং গরমে লবণমিশ্রিত পানি পান, বেশি বেশি পানি পান, ঘর ঠাণ্ডা রাখা (যাদের এসি নেই তারা ঘরের মধ্যে বালতিতে বরফ পানি রাখা ও ঘরের পর্দা ভিজিয়ে রাখা), পচা-বাসি ও খোলা খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর সংখ্যা। রাজধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট (শিশু হাসপাতাল), স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-সহ বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে এসব হাসপাতালে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গত কয়েক দিনের গরমে শুধু ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই শতাধিক শিশু। মুগদা হাসপাতালের শিশু বিভাগেও ইতিমধ্যে রোগীতে সব শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। উপজেলা, জেলা সদর ও সারা দেশে সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এই চিত্র।

হাসপাতালগুলোতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, হাসপাতালে শয্যা সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। রোগী নিয়ে ওয়ার্ডের মেঝে বা বারান্দায় পড়ে থাকতে হচ্ছে।

এছড়া সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির কর্মকর্তারা পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য রোগীদের বাইরের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পাঠিয়ে কমিশন নিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে ঢাকার বাইরে পিরোজপুর, যশোর, বগুড়ায় প্রচণ্ড তাপদাহে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।

প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ ও তীব্র গরমে পিরোজপুর জেলা হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। শনিবার পিরোজপুর জেলা হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ দেখা গেছে। জায়গা না পেয়ে অনেক রোগী হাসপাতালের বারান্দায় অবস্থান নিয়েছেন।

বর্তমানে পিরোজপুর জেলা হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি রয়েছে ১৭৫ জন। তাঁদের মধ্যে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ২৯, মেডিসিন পুরুষ ওয়ার্ডে ৪৬, মহিলা ওয়ার্ডে ৫৩, শিশু ওয়ার্ডে ২৯, গাইনি ওয়ার্ডে ৬ ও স্ক্যানু ওয়ার্ডে ১২ জন রোগী ভর্তি রয়েছে।

পিরোজপুরের সিভিল সার্জন মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘তীব্র তাপপ্রবাহে হাসপাতালগুলোয় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। জেলা হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৭০ থেকে ১৮০ জন রোগী ভর্তি থাকলেও আমাদের সেবা কার্যক্রমে কোনো কমতি হচ্ছে না। আমাদের পর্যপ্ত খাবার স্যালাইন, আইভি স্যালাইন ও ওষুধ মজুদ রয়েছে।’

তীব্র তাপপ্রবাহে যশোরে হার্ট অ্যার্টাক ও স্ট্রোকে আক্রান্ত্রের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। প্রতিকূল পরিস্থিতি যত দীর্ঘ হচ্ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৩ দিনে ৫০০ রোগী যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে আসে। এর ভেতর ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।

যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক বিচিত্রা মল্লিক বলেন, ‘তীব্র তাপপ্রবাহে হার্ট অ্যাটার্কে ও স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। ১৭ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত জরুরি বিভাগে এ ধরনের ৮ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে আনার সময় পথেই তাদের মৃত্যু হয়েছে।’

হাসপাতালের মেডিসিন, সিসিইউসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিদ্যমান শয্যার দুই থেকে তিন গুণ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। শয্যা না পেয়ে রোগীরা মেঝেতে প্রচণ্ড গরমের ভেতর ঠাসাঠাসি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ওয়ার্ডে রোগীর ভিড়ে অবর্ণনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ২৮ শয্যার করোনারি কেয়ার ইউনিটে ১৭ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত ৮১ জন রোগী ভর্তি হয়। এর ভেতর ৪ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। শয্যা অনুপাতে সিসিইউতে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ। পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে তিন দিনে ৯১ জন রোগী ভর্তি হয়। এই ওয়ার্ডে মৃত্যুবরণ করেছে দুই রোগী। ২৬ শয্যার পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে আগের মিলে মোট রোগী ছিল ৮৬ জন। মহিলা মেডিসিন দুটি ওয়ার্ডে ভর্তি হয় ১৭৪ রোগী। ২১ শয্যার এই দুটি ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা ছিল ৭ গুণ।

এ ছাড়া ডায়রিয়া ওয়ার্ডে এ সময় ৩৮ জন ও শিশু ওয়ার্ডে ৭৬ জন রোগী ভর্তি হয়। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৫টি শয্যার বিপরীতে ৫ গুণের বেশি ২৭ জন ও শিশু ওয়ার্ডে ২৪টি শয্যার বিপরীতে ৩ গুণ রোগী ভর্তি ছিল।

বগুড়ার হাসপাতালগুলোতেও রোগী বেড়েছে, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যা বেশি। সর্দিজ্বর ও নিউমোনিয়াসহ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। বহির্বিভাগেও রোগী বেড়েছে বলে জানা গেছে। ঈদের পর থেকেই বগুড়া সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল ও শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে রোগী বেড়েছে, বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।

বগুড়া শজিমেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. ওয়াদুদ জানান, ঈদের পর থেকেই হাসপাতালে বহির্বিভাগ ও ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন সারা দেশে সব সরকারি হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেন, কোনো রোগী চিকিৎসার বাইরে থাকবে না। হাসপাতালে পর্যাপ্ত স্যালাইন ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। শনিবার বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), দেশের সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তার কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে, যাতে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখা হয়। যেসব রোগীর অপারেশন দেড় মাস পরে করলে সমস্যা হবে না, সেসব রোগীর অপারেশন বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সারা দেশে। একই সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজে ক্লিনিক্যাল ক্লাসগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমবিবিএস শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই নির্দেশনা পেয়ে সারা দেশে ডাক্তার ও নার্সরা বিরামহীনভাবে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

গরমজনিত রোগে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুররা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। হিট স্ট্রোকেও তারাই আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, গরমের কারণে হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়া, আমাশয়, জ্বর, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, জন্ডিসে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। শিশুদের সর্দি, কাশি, ভাইরাল জ্বর ও ডায়রিয়া বেশি হচ্ছে। চিকিৎসকরা সতর্ক থাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। সতর্ক থাকলে ঘরে বসে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে গরম এড়িয়ে চলা। গরমে কীভাবে নিরাপদ থাকতে হবে, সেই পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। প্রয়োজন না হলে শিশু ও বৃদ্ধরা যেন বাইরে না যায়। বাইরে গেলে রোদ এড়িয়ে যেতে হবে। রাস্তাঘাটের খোলা খাবার খাওয়া যাবে না। লবণমিশ্রিত পানি পান করতে হবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে। ঘরের মধ্যে এসি না থাকলে বালতির মধ্যে বরফ দিয়ে রাখতে হবে। পর্দাগুলো ভিজিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, গরমে খেটে খাওয়া মানুষ, রিকশাওয়ালা ও শ্রমিকরা বেশি কষ্ট পাচ্ছেন এবং নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া লিভার, কিডনি ও হার্টের রোগীরা প্রয়োজন না হলে যেন ঘরের বাইরে না যায়। লবণমিশ্রিত পানি খেতে হবে। রাস্তার খোলা খাবার খাওয়া যাবে না। রাস্তাঘাটে শ্রমিকদের তাল পাতার মাথাল ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, যতটা পারা যায় রোদ এড়িয়ে চলতে হবে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাফি আহমেদ বলেন, প্রচণ্ড গরমে বয়স্কদের সঙ্গে সঙ্গে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া, ভাইরাল জ্বর বেশি হচ্ছে। এ থেকে রক্ষা পেতে পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। ঘর ঠাণ্ডা রাখতে হবে। পচা-বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। গরমে খাবারে পচন ধরে, ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস দেখা দেয়। এসব খাবার পরিহার করতে হবে। ঘরের দরজার পর্দা ভিজিয়ে রাখতে হবে। ঘরের মধ্যে বালতিতে বরফ দিয়ে পানি রাখতে হবে। দরজা, জানালা সকালে বন্ধ রেখে এগুলো করতে হবে। বিকালে দরজা-জানালা খুলতে হবে, যখন রোদ না থাকে। শিশুদের কোনো অবস্থাতেই বাইরে গরমে নেওয়া যাবে না। সুতি, ঢোলা কাপড় পরিধান করতে হবে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক ও বাংলাদেশের প্রখ্যাত নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, গরমে সব বয়সে হিট স্ট্রোক হতে পারে। তবে বয়স্ক ও শ্রমজীবী মানুষদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সর্বাধিক। লবণমিশ্রিত পানি খেতে হবে। যতটুকু সম্ভব গরম এড়িয়ে থাকতে হবে। ঠাণ্ডা জাতীয় তরল খাবার খেতে হবে। সুতি, ঢোলা কাপড় পরিধান করার পরামর্শ দেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *