প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি মন্ত্রী-এমপির ১৩ স্বজন
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দুই জন প্রেসিডিয়াম সদস্য, একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারী এমপিদের ভাগ্য নির্ধারণ হবে আগামী ৩০ এপ্রিল। ঐ দিন সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতে আওয়ামী লীগ প্রধান গত বৃহস্পতিবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের প্রার্থী না হওয়ার নির্দেশ দেন। তার এই নির্দেশনা চিঠি পাঠিয়ে ও ফোন করার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এমপিদের কাছে পাঠিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলীয় প্রধানের নির্দেশনা মানছেন না অনেকে।
চার ধাপে এবার নির্বাচন উপযোগী ৪৮৫টি উপজেলায় ভোট হবে। প্রথম ধাপে ১৫০টি উপজেলার ভোট সামনে রেখে প্রায় ২ হাজার প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। গত বুধবার এসব মনোনয়নপত্রের বাছাই পর্ব শেষ হয়েছে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল গতকাল। কিন্তু শেষ দিনেও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই হারুন অর রশীদ হীরা, আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহজাহান খান এমপির ছেলে আসিবুর রহমান খান ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা। হারুন অর রশীদ হীরা টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলা, আসিবুর রহমান খান মাদারীপুর সদর উপজেলা এবং আতাউর রহমান আতা কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী। সব মিলিয়ে মন্ত্রী-এমপির ২৮ জন স্বজন নির্বাচনের মাঠ ছাড়েননি। এই সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। এর মধ্যে ১৩ জনের মতো আছেন প্রথম পর্বে। বাকিরা দ্বিতীয় ধাপে বা অন্য পর্বে ভোট করবেন। কেউ কেউ আরো কিছু দিন অপেক্ষা করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথাও জানিয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে জানা গেছে। দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন, তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এরকম বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগেও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের দল থেকে পদ হারানো বা বহিষ্কারের নজির রয়েছে। আওয়ামী লীগের একসময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী যখন দল থেকে বহিষ্কৃত হন, তখন তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন।
এদিকে মন্ত্রি-এমপির স্বজনদের মধ্যে মাত্র দুই জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। নাটোরের সিংড়ায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ পলকের শ্যালক লুত্ফুল হাবিব রবিবার সরে দাঁড়িয়েছেন। তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগ ওঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী স্থানীয় সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলামের ভাগনে কাজী জাহিদ আল রহমান নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। তিনি উজানচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
জানা গেছে, প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্যদের প্রভাব থাকে। প্রশাসনেও তারা সেই প্রভাব বিস্তার করেন। আর সেই সুযোগে অনেক মন্ত্রী-এমপি তাদের আত্মীয়-স্বজনকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছেন। সেই তালিকায় সন্তান, আপন ভাই, চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, খালাতো ভাই, চাচা, শ্যালকসহ নানা ধরনের আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পরও উপজেলা নির্বাচনের মাঠ থেকে এখনই সরতে রাজি নন স্থানীয় মন্ত্রী-এমপির স্বজনরা। নানা কৌশলে ভোটের মাঠে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। সংশ্লিষ্ট এমপি-মন্ত্রীরাও তাদের পক্ষে সামনে আনছেন নানা ‘যুক্তি ও অজুহাত’। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলা বা সরাসরি তার কাছ থেকে নির্দেশনার অপেক্ষাও করছেন অনেকেই। এছাড়া নানাভাবে সময়ক্ষেপণ করতে চাইছেন তারা। বোঝার চেষ্টা করছেন দলের অবস্থান শেষ পর্যন্ত কতটা কঠোর হয়। এর পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চান তারা।
গতকাল প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী। তিনি সুবর্ণচরে প্রার্থী হয়েছেন। নোয়াখালীর হাতিয়ায় নারী ও পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে গেছেন। বাকি আছে চেয়ারম্যান পদের ভোট। সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী তার ছেলে আশিক আলীকে প্রার্থী করেছেন। আওয়ামী লীগের আর কেউ প্রার্থী হওয়ার সাহস করেননি। ছেলের প্রার্থিতা কোনো কারণে বাতিল হয়ে গেলে চেয়ারম্যান পদ যাতে পরিবারের মধ্যেই থাকে, সেজন্য সংসদ সদস্য নিজের স্ত্রী দুই বারের সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদৌসকেও ‘ডামি’ প্রার্থী করেছেন। এখন সংসদ সদস্যের স্ত্রী ও ছেলে সরে গেলে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী থাকবেন না। এর আগে গত দুই মেয়াদে হাতিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন সংসদ সদস্যের ভাই মো. মাহবুব মোর্শেদ। জাতীয় পার্টির (জাপা) মুশফিকুর রহমান এখানে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে লড়াই করে মাত্র ৬ হাজার ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। আর এবার তিনি উপজেলা ভোটে দাঁড়িয়েছেন।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া একমাত্র ব্যক্তি বর্তমান চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফয়সালের (বিপ্লব) চাচা। ফলে তিনি এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বািয় জয়ী হওয়ার পথে। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন ও পাশের সোনাতলায় তার ভাই মিনহাদুজ্জামান উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন।
এছাড়া দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত হবে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে এরই মধ্যে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার। তিনি কুমিল্লা-১০ আসনের সংসদ সদস্য এবং সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের আপন ছোট ভাই। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে তিন জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। তাদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. জামিল হাসান দুর্জয়ও আছেন। দুর্জয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও গাজীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য রুমানা আলী টুসির বড় ভাই। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. ইসরাফিল হোসেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ মালেক স্বপনের আপন ফুফাতো ভাই। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদের ছোট ভাই ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় এবারও প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আনিছুজ্জামান। তিনি মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের বর্তমান এমপি ফয়সাল বিপ্লবের আপন চাচা। নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন ঘোড়াশাল পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র মো. শরীফুল হক। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খান দীলিপের স্ত্রীর বড় ভাই। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নীলফামারী-১ (ডোমার-ডিমলা) আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন সরকারের চাচাতো ভাই মো. আনোয়ারুল হক সরকার এবং ভাতিজা মো. ফেরদৌস পারভেজ প্রার্থী হয়েছেন। পাবনা-৩ (চাটমোহর-ভাঙ্গুড়া-ফরিদপুর) আসনের সংসদ সদস্য এবং পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. মকবুল হোসেনের বড় ছেলে গোলাম হাসনায়েন রাসেল এবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হচ্ছেন। কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিকের চাচাতো ভাইপো হাবিব উল্লাহ মহেশখালী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। গাজীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের ভাতিজা মুরাদ কবীর গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের এমপি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সোলায়মান হক জোয়ার্দারের ভাতিজা নঈম হাসান জোয়ার্দার চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের এমপি আলী আজগার টগরের ছোট ভাই আলী মুনছুর বাবু দামুড়হুদা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সংসদ সদস্য শাহাব উদ্দিনের ভাগনে সোয়েব আহমদ নির্বাচনি প্রচারণার অংশ হিসেবে শুক্রবারও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ ও পথসভা করেছেন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দিনাজপুর-৫ (ফুলবাড়ী-পার্বতীপুর) আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের ছোট ভাই উপজেলা নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের তিন জন সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘনিষ্ঠ স্বজনরা ভোট করছেন এমন সংসদ সদস্যদের সবাইকে দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাউকে কাউকে একাধিকবার ফোন করে স্বজনদের বসিয়ে দিতে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা গড়িমসি করছেন। নানা অজুহাত ও সমস্যার কথা তুলে ধরছেন। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের অনুরোধ করা ছাড়া তাদের হাতে কোনো বিকল্প নেই। ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের বৈঠক রয়েছে। ঐ বৈঠকে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার হাতে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের তালিকা তুলে দেওয়া হবে। তখন হয়তো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে।