ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের নজর এখন গাজার সৈকতের দিকে
সমুদ্রসৈকতে একটি বাড়ি করতে কে না চায়? ইসরায়েলের অতি ডানপন্থী অনেকের জন্য লোভনীয় সৈকতের তালিকায় এখন গাজা যুক্ত হয়েছে।
ইসরায়েলের বসতি আন্দোলনের একজন নেত্রী ৭৮ বছর বয়সী দানিয়েলা উইসকে প্রশ্নটি করেই দেখুন না। তিনি বলেন, তাঁর কাছে ৫০০ মানুষের একটি তালিকা আছে। এসব মানুষ এখনই গাজায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
দানিয়েলা উইস বলেন, ‘তেল আবিবে আমার বন্ধুরা আছে। তারা বলে, আমার জন্য গাজার উপকূলের কাছে একটি প্লট রাখার কথা ভুলে যেয়ো না। কারণ, এই উপকূল অপূর্ব সুন্দর, অপূর্ব এর সোনালি বালু।’
দানিয়েলা তাঁদের বলেন, উপকূলের প্লটগুলোর ইতিমধ্যে বায়না করা হয়ে গেছে।
দানিয়েলা উইস ইসরায়েলভিত্তিক নাচালা (স্বদেশ) নামের একটি চরমপন্থী সংগঠনের প্রধান। ইসরায়েলের দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনে কয়েক দশক ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের এসব ভূমি দখল করেছিল ইসরায়েল।
২০০৫ সাল থেকেই বসতি সম্প্রসারণের পক্ষের লোকজনের একাংশ গাজায় ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন লালন করে আসছে। ওই সময় ইসরায়েল একতরফাভাবে বসতি স্থাপনকারীদের সরে যেতে নির্দেশ দেয়। তখন ২১টি বসতি ভেঙে ফেলা হয়েছিল এবং বসতির প্রায় ৯ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে নিয়েছিলেন ইসরায়েলের সেনারা।
অনেক বসতি স্থাপনকারী এটিকে রাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতা ও কৌশলগত ভুল হিসেবে দেখছেন।
তবে জনমত জরিপে বলছে, অধিকাংশ ইসরায়েলি গাজায় আবার বসতি স্থাপনের বিপক্ষে। তা ছাড়া এটা সরকারের নীতিতেও নেই। তবে গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর বিষয়টি নিয়ে ইসরায়েলের সরকারের কিছু কর্তাব্যক্তি সোচ্চার হয়েছেন এবং উগ্রপন্থীদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে।
দানিয়েলা উইস খুব গর্ব করে পশ্চিম তীরের একটি মানচিত্র দেখালেন। সেখানে গোলাপি রঙের বিন্দু দিয়ে ইহুদি বসতিগুলো দেখানো হয়েছে। মানচিত্রের সর্বত্র বিন্দুগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। যে ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্র নির্মাণের আশা দেখছেন অথবা দেখেছিলেন, সেটিকে গিলে ফেলা হচ্ছে।
এসব এলাকায় এখন প্রায় সাত লাখ ইহুদি রয়েছে। এ সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদসহ অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে বসতি স্থাপনকে আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ বলে মনে করে। তবে ইসরায়েল তা মনে করে না।
তেল আবিবে আমার অনেক বন্ধু আছে। তারা বলেছে, তাদের জন্য গাজার উপকূলের কাছে একটি প্লট রাখার কথা না ভুলতে। কারণ, এই উপকূল অপূর্ব সুন্দর, অপূর্ব এর সোনালি বালু।
দানিয়েলা উইস হলেন ইহুদি বসতি স্থাপনকারী সংগঠনের নেত্রী
দানিয়েলের সঙ্গে পশ্চিম তীরের কেদুমিম বসতিতে তাঁর বাড়িতে দেখা হয়। এলাকাজুড়ে পাহাড়ের চূড়ায় আর উপত্যকায় ছড়ানো-ছিটানো বাড়িগুলোর লাল ছাদ দেখা যায়। প্লাস্টারে ঝোলানো হাত নিয়ে তিনি অবিরাম ছুটে চলছেন।
দানিয়েলের দৃষ্টিতে ভবিষ্যতে গাজা হবে ইহুদিদের। সেই গাজায় যেখানে এখন ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। দানিয়েলে বলেন, ‘গাজার আরবরা গাজা উপত্যকায় থাকবে না। তাহলে কারা থাকবে? ইহুদিরা।’
দানিয়েলা উইস দাবি করেন, ফিলিস্তিনিরা গাজা ছাড়তে চান। অন্য দেশগুলোর উচিত, তাঁদের ঢুকতে দেওয়া। তবে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি ‘ফিলিস্তিনি’ শব্দটি কদাচিৎ ব্যবহার করেছেন।
দানিয়েলা উইস বলেন, ‘পৃথিবী অনেক বড়। আফ্রিকা বিশাল। কানাডাও বড়। বিশ্ব গাজার লোকদের ঠাঁই করে দিতে পারবে। আমরা কীভাবে? আমরা উৎসাহ দেই। গাজার যেসব ফিলিস্তিনি ভালো, তারা এটা করতে সুযোগ পাবে। আমি জোরজবরদস্তির কথা বলছি না, আমি তাদের সুযোগ পাওয়ার কথা বলছি। কারণ, তারা যেতে চায়।’
ফিলিস্তিনিরা তাঁদের স্বদেশ ছাড়তে চান এ ধরনের কোনো প্রমাণ নেই। তবে জীবন বাঁচাতে অনেকেই সাময়িকভাবে দেশ ছাড়তে চাচ্ছেন, সেটা হয়তো হতে পারে। অধিকাংশ ফিলিস্তিনিরই দেশ থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। কারণ, সীমান্তগুলো ইসরায়েল ও মিসর কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। তা ছাড়া কোনো দেশ ফিলিস্তিনিদের শরণার্থী হিসেবে নেওয়ার প্রস্তাবও দেয়নি।
আমি তাঁকে বলি, এ মন্তব্য জাতি হত্যার পরিকল্পনার মতো শোনাচ্ছে। তিনি তা অস্বীকার করলেন না।
দানিয়েলা বলেন, ‘আপনি এটিকে জাতিগত নিধন বলতে পারেন। আমি আবারও বলছি, আরবরা থাকতে চায় না। স্বাভাবিক আরবরা গাজায় বসবাস করতে ইচ্ছুক নয়। আপনি এটিকে জাতি হত্যা অথবা বর্ণবাদ বলতে পারেন। যা চান তা–ই বলুন। যাই বলুন না কেন, সেটি আপনার পছন্দ। আমি ইসরায়েল রাষ্ট্রকে রক্ষায় এই পথ বেছে নিয়েছি।’
কয়েক দিন পর আরেক বসতি স্থাপনকারীর বাড়িতে ছোট জমায়েতের আয়োজন করা হয়। সেখানে কেক ও পপকর্ন খাওয়ার ফাঁকে গাজায় ফিরে যাওয়ার চিন্তাটি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন দানিয়েলা।
দানিয়েলা উইস বড় পর্দায় (প্রজেক্টর) গাজার নতুন মানচিত্র দেখাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি ‘গাজায় ফিরে যাও’ লেখা প্রচারপত্রও দেখাচ্ছিলেন।
দানিয়েলা উইস বলেন, ‘মানুষ আমাকে প্রশ্ন করেছিল যে এটা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?’
ওই জমায়েতে উপস্থিত অল্প কিছু মানুষ দানিয়েলার কথায় আশ্বস্ত হন। সারাহ মানিলা নামের একজন বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব আমি গাজায় যেতে চাই। তারা যখন আমাকে ডাকবে, আমি তখনই গাস কাতিফে (গাজায় সাবেক ইসরায়েলি বসতি) ফিরে যাব।’
তাহলে সেখানে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের কী হবে। জানতে চাইলে সারাহ বলেন, ‘গাজা মোটেও খালি হয়নি। তাই বসতি কোথায় স্থাপন করতে হবে, সে বিষয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনাকে শুধু ফিরে এসে নতুন করে একটি বসতি গড়ে তুলতে হবে।’
গাজা মোটেই ফাঁকা হয়নি। তবে গাজার অনেক এলাকা–ই গত ছয় মাসে ইসরায়েলি বাহিনীর অনবরত বোমাবর্ষণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
গাজা নিয়ে দানিয়েলার ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, এটি ইহুদিদের হবে। তিনি বলেন, ‘গাজার আরবরা গাজা উপত্যকায় থাকবে না, তাহলে কারা থাকবে? ইহুদিরা।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলের কথায়, ‘এটি (গাজা) বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কবরস্থান।’
গাজায় হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ৩২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। এ তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার কিছু সদস্যের কাছেও রক্তাক্ত ফিলিস্তিন এখন বসতি স্থাপনের জন্য উপযুক্ত। তাঁদের মধ্যে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী নেতা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেন গেভির রয়েছেন, যিনি নিজেও একজন বসতি স্থাপনকারী।
গত জানুয়ারির শেষ দিকে ‘বসতি স্থাপন নিরাপত্তা আনে’, শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রায় এক হাজার উগ্রবাদী ইসরায়েলি অংশ নেন। যাঁরা গাজায় ফিরে যাওয়ার দাবি করছেন। তাঁদের মধ্যে বেন গেভিরও ছিলেন।
মঞ্চ থেকে উচ্ছসিত কণ্ঠে বেন গেভির বলেন, ‘এটাই বাড়ি ফেরার সময়। ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। আমরা যদি আরেকটি ৭ অক্টোবর না চাই, তাহলে আমাদের নিজেদের বাড়ি ফিরতে হবে এবং ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে।’
বাঁকা একটি গাছের ছায়ায় ইহুদা শিমন দুই সন্তানের সঙ্গে খেলছিলেন। তাঁরা গাছের ডালের সঙ্গে ঝোলানো দোলনার বিছানার (হ্যামক) ওপর শুয়ে ছিলেন।
ইহুদা শিমন ফিলিস্তিনের নাবলুস শহরের কাছে পশ্চিম তীরের হাভাত গিলাদ নামের একটি বসতি ঘাঁটিতে ১০ সন্তানকে বড় করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর চারপাশে অসংখ্য ফিলিস্তিনি গ্রাম। সবচেয়ে নিকটবর্তী গ্রামটি মাত্র ৫০০ মিটার দূরে। অথচ তাঁদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।
শিমন এর আগেও গাজায় বসবাস করেছেন। তিনি দাবি করেন, গাজায় ফিরে যাওয়াটা তাঁদের ঈশ্বর প্রদত্ত অধিকার। তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই এটা করা উচিত। এটি ইসরায়েলের অংশ। ঈশ্বর আমাদের এই ভূখণ্ড দিয়েছেন এবং আপনি ঈশ্বরের কাছে গিয়ে বলতে পারবেন না, আপনি আমাকে দিয়েছেন আর আমি এটি অন্যদের দিয়েছি, না। আমি বিশ্বাস করি, শেষ পর্যন্ত আমি গাজায় ফিরে যাব।’
তাহলে ফিলিস্তিনিদের কী হবে—এ প্রশ্নের জবাবে শিমন বলেন, বিশ্বের আরও ৫২টি স্থানে তাঁদের যাওয়ার জায়গা আছে। ৫২টি মুসলিম দেশ। তিনি বলেন, নতুন গাজা হবে আরেকটি তেল আবিব।
পশ্চিম তীরে বড় বড় অবৈধ বসতির পাশাপাশি শিমনের ঘাঁটির মতো উপনিবেশ তরতর করে বাড়ছে। এসব স্থাপনা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডকে টুকরা টুকরা করছে এবং উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবরের পর ফিলিস্তিনিদের ওপর বসতি স্থাপনকারীদের হামলার ঘটনা বেড়েছে। জাতিসংঘ অনেক আগে থেকেই বলছে, বসতিগুলো ‘শান্তির পথে বাধা’।
বসতি স্থাপনকারী সংস্থাগুলো আবারও গাজার দিকে নজর দিচ্ছে। গাজার সমুদ্রসৈকতে বসতি স্থাপনকারীদের পৌঁছানোর আসলেই কি কোনো সম্ভাবনা রয়েছে?
একজন ফ্রিল্যান্স ইসরায়েলি সাংবাদিক আমাকে বলেন, ‘কখনোই তা হবে না।’ তিনি বলেন, গাজায় আবার বসতি স্থাপন করার আহ্বান নীতিতে রূপ নেবে না।