Home অপরাধ ক্ষতিকর রাসায়নিকে পাঁকানো হয়েছে মধুপুরের আনারস, হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য
মার্চ ২৪, ২০২৪

ক্ষতিকর রাসায়নিকে পাঁকানো হয়েছে মধুপুরের আনারস, হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য

পবিত্র রমজান মাসে বাজারে আনারসের চাহিদা বেড়ে যায়। এই বাজার ধরতে টাঙ্গাইলের মধুপুরে চাষিরা মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করে মৌসুমের আগেই ‘জলডুগি’ জাতের আনারস পরিপক্ব করে তুলেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, জুন-জুলাই মাসে ফসল তোলার কথা থাকলেও রমজান মাস সামনে রেখে রাসায়নিক ব্যবহার করে পাকানো হচ্ছে আনারস। ফলে মার্চ মাসেই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে পাকা আনারস।

ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজার দখল করে নিয়েছে মধুপুরের ক্যালেন্ডার ও জলডুগি আনারস।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে মধুপুরে ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারস আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৩২৪ হেক্টরে জলডুগি এবং ৬ হাজার ৫১০ হেক্টরে ক্যালেন্ডার প্রজাতির আনারস আবাদ হয়েছে। এ ছাড়াও পরীক্ষামূলকভাবে এমডি-টু জাতের আনারস আবাদ হয়েছে ৬ হেক্টর জমিতে। প্রাকৃতিকভাবে আনারস গুটি ধরা থেকে পাকা পর্যন্ত ছয় থেকে সাত মাস সময় লাগে। জলডুগি আনারস চারা রোপণ থেকে পাকা পর্যন্ত সময় লাগে ১২ মাস। আনারস জুন-জুলাই মাসে বাজারে আসার কথা থাকলেও মার্চেই বিক্রি শুরু হয়েছে।

কৃষি অফিস সূত্রে আরও জানা যায়, বর্তমানে মধুপুরে ২৬টি পাইকারি ও ১৬২টি খুচরা রাসায়নিক বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান আছে। দেশি, বিদেশি ও স্থানীয় ৭০টি কোম্পানির রাসায়নিক উপজেলায় বিক্রি হয়। চাষিদের একটি সূত্র জানায়, অধিক লাভের আশায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে অসময়ে এ জাতের আনারস পাকিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন। এতে ভিটামিন ও খনিজ লবণসমৃদ্ধ এই ফল ‘বিষে’ পরিণত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহৃত আনারস খেলে অ্যালার্জি, চর্মরোগ থেকে শুরু করে ক্যানসারেও আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অধিক লাভের আশায় কৃষক ও অসাধু ব্যবসায়ীরা আনারসের চারায় গুটি ধরা, বড় করা ও পাকানোর কাজটি করছেন রাসায়নিক দিয়ে। ৪৫ পাতা হওয়ার পর আনারসের চারায় গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করা যায়। কিন্তু কিছু চাষি ১২-১৫ পাতা হওয়ার পরই তা ব্যবহার করছেন। অপর দিকে ১৬ লিটার পানিতে ১৬ মিলিগ্রাম রাসায়নিক মিশিয়ে চারায় স্প্রে করার কথা কৃষি বিভাগ জানালেও কৃষকরা ১৬ লিটারে দুই থেকে তিনশ মিলিগ্রাম ব্যবহার করছেন।

সরেজমিনে মধুপুর উপজেলার কুড়িবাড়ী, হাগুড়াকুড়ি, শোলাকুড়ি, ঘুঘুর বাজার, গায়রা ও ইদিলপুর গ্রামে ঘুরে বিভিন্ন বাগানে দেখা যায়, শ্রমিকরা আনারসে রাসায়নিক ছিটাচ্ছেন। কৃষকরা জানান, দ্রুত পাকানোর জন্য শুধু ইথোপেন রাসায়নিক স্প্রে করা হচ্ছে ক্ষেতে।

চাষি সুকুমার বলেন, আনারস গাছে কোনো দিন একসঙ্গে সব গাছে ফল ধরে না। কিছু কিছু গাছে ফল ধরবে ও পাকবে। ওই আনারস খেতে স্বাদ বেশি, মিষ্টিও বেশি। শেয়ালসহ বিভিন্ন পশুপাখি আনারস খেয়ে ফেলে এজন্য আরও বেশি ক্ষতি হয়।

তিনি আরও বলেন, আনারসের চারা বড় হলে গাছের মাথায় গর্ভবতী (রাসায়নিক) দিলে কয় দিন পরেই সব গাছে গুটি ধরে। এরপর ১৫ থেকে ১৬ দিন পরপর দুই থেকে তিনবার হরমোন দেই। আনারস বড় হয়। পাকানোর ওষুধ দিলে একবারে পাকে। এক দিক থেকে কাটি আর বিক্রি করি।

শ্রমিক আব্দুস সামাদ ও হায়দার আলী বলেন, ১৬ লিটার পানির কন্টেইনারে দুই থেকে তিন বোতল রাসায়নিক মিশিয়ে আনারসে স্প্রে করছি। সাত দিনের মধ্যেই সুন্দর রঙ হয়। কয় দিন আগে যে আনারসে ওষুধ দিয়েছি, সেগুলোই বিক্রি হচ্ছে।

আনারস ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন বলেন, মধুপুরে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার আনারস বেচাকেনা হয়। বর্তমানে আনারস ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কয়েক দিন পর রমজান মাস। তখন বিক্রি বেশি হবে। আর দামও বাড়বে।

আরেক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ৯০ লাখ টাকা দিয়ে ৩ লাখ ৭০ হাজার আনারস কিনেছি। সেই আনারসগুলো বাজারজাত শুরু করেছি। ঢাকা, উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন জেলায় আনারস বিক্রি হচ্ছে। জলডুগি প্রতিটি আনারস ক্ষেতেই বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকা দামে। রোজা শুরু হলে আনারসের টান বেশি থাকবে। তখন আনারস ক্ষেত থেকে বিক্রি হবে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক কৃষিবিজ্ঞানী ড. আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, আনারসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ লবণ থাকে। আনারসে এখন বিভিন্ন রসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে। হরমোন বা ইথোপেন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো ভারত-চীন থেকে আসে। বাংলাদেশে যখন এই রাসায়নিক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয় তখন আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। ক্ষতিকর এই রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে অ্যালার্জিসহ নানা চর্মরোগ, বদহজম, গ্যাস্ট্রিক, ক্যানসার হয়ে থাকে।

মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল বলেন, মধুপুরের আনারস খেতে খুব সুস্বাদু। ক্যালেন্ডার ও জলডুগিসহ বিভিন্ন জাতের আনারসের চাষ করছেন কৃষকরা। এ ছাড়াও বিদেশি এমডি-টু জাতের আনারসের চাষ করছেন। অনেকে আনারস পাকানোর ওষুধ ব্যবহার করে ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *