ঈদমুখী ঢাকাই সিনেমা
বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকাই সিনেমার মুক্তির হিসাব-নিকাশ পাল্টেছে। বছর বছর ঈদে ছবি মুক্তির সংখ্যা বাড়ছেই। ঈদ ছাড়া বছরে অন্য সময় মুক্তি পাওয়া বেশির ভাগ ছবিই ব্যর্থ হচ্ছে। এসব নানা কারণে এখন ঈদেই ছবি মুক্তির জন্য প্রযোজক-পরিচালকেরা স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন।
পবিত্র ঈদুল ফিতরে এখন পর্যন্ত ১১টি ছবি মুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে—‘রাজকুমার’, ‘কাজলরেখা’, ‘ওমর, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘ডেড বডি’, ‘চক্কর’, ‘পুলসিরাত’, ‘মোনা: জ্বীন ২’, ‘আহারে জীবন’, ‘মায়া: দ্য লাস্ট লাভ’ ও ‘এশা মার্ডার’। তবে শেষ পর্যন্ত কটি মুক্তি পাবে, সেটাই এখন দেখার।
চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ কেউ মনে করেন, বছরের অন্য সময় সিনেমা মুক্তি পেলেও দর্শক আসছেন না প্রেক্ষাগৃহে। এতে করে বড় বাজেটের ছবিও মুখ থুবড়ে পড়ছে। ঈদে মানুষ একটু উৎসবের আমেজে থাকেন, পারিবারিক বিনোদনের জন্য বেছে নেন বাংলা সিনেমা। তাই মনে করা হচ্ছে, এই বাড়তি দর্শক ধরতেই কয়েক বছর ধরে ঢাকাই সিনেমা কার্যত ঈদমুখী।
যেমন চলছে ঈদের পাঁচ ছবি
ফলে অন্য সময়ের জন্য নির্মাণ করা হলেও প্রযোজকের ছবি মুক্তির জন্য ঈদ উৎসবকেই বেছে নিচ্ছেন। যেমন বলা যায় ‘দেয়ালের দেশ’ ছবিটির কথা। ঈদে মুক্তির মিছিলে থাকলেও ছবিটি ঈদের জন্য নির্মাণ করা হয়নি। ছবিটির পরিচালক মিশুক মনি জানান, যখন ছবিটির নির্মাণ শুরু হয়, তখন ঈদ মাথায় ছিল না। তিনি বলেন, ‘সিনেমাটির কাজ শেষ করতে করতে ঈদ এসে গেছে। ঈদে সিনেমা হলে বাড়তি দর্শক আসে। অন্য সময় সেটা দেখা যায় না।’
এ ব্যাপারে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহিন সুমন বলেন, ‘গত কয়েক বছরের ঈদে দেড় ডজনের বেশি ছবি মুক্তি পেয়েছে। কটি ব্যবসা করেছে? জানামতে, ঈদে ব্যবসাসফল হয়েছে “পরাণ”, “হাওয়া, “প্রিয়তমা”, “সুড়ঙ্গ”সহ মাত্র কয়েকটি ছবি। যদিও “হাওয়া” ঈদের দুই সপ্তাহ পর মুক্তি পায়। কিন্তু এসব সফল ছবির সঙ্গে মুক্তি পাওয়া বাকিগুলো পুরোপুরিই ব্যর্থ। তাহলে এত ছবি মুক্তি দিয়ে লাভটা হলো কী?’ তবে এই পরিচালকের ধারণা, ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত কোনো কোনো ছবি দর্শক গ্রহণ না করলেও, বিনিয়োগ না ফিরলেও আলোচনা তো তৈরি হচ্ছে। সেটিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন পরিচালকেরা।
লোকসান, তবু কেন ঈদে মুক্তি
ঈদে মুক্তি পাওয়া বেশির ভাগ ছবি ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ। তবু কেন সবাই নিজেদের ছবি মুক্তি দিতে ঈদেই ভিড় করছেন? নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পরিচালক বলেন, ‘কয়েকটি পরিবেশক প্রতিষ্ঠান থেকে জানতে পেরেছি, গত বছর ঈদে প্রেক্ষাগৃহে “ক্যাসিনো”, “প্রহেলিকা”, “লাল শাড়ি”, “আদম”সহ অনেকগুলো ছবির বিনিয়োগের ২০ বা ৩০ শতাংশও ফেরত আসেনি। নাম বলছি না, একটি ছবি থেকে তো বিনিয়োগের ১০ শতাংশও ফেরেনি। তার আগের বছরে ঈদে মুক্তি পাওয়া গলুই, শান আলোচনায় থাকলেও পুঁজি পুরোপুরি ওঠেনি। ওই সময় ছবি দুটির প্রযোজকই প্রেক্ষাগৃহ থেকে ছবি দুটির লোকসানের কথা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন। একই সঙ্গে মুক্তি পাওয়া “বিদ্রোহী” এবং “বড্ড ভালোবাসি”ও ব্যর্থ হয়েছে।’
তাহলে ঈদেই কেন মুক্তি? জানতে চাইলে ওই পরিচালক আরও বলেন, ‘কোনো কোনো ছবির প্রযোজক, পরিচালকদের ভাবনা, ঈদের সময় বাড়তি দর্শকের একটা জোয়ার থাকে। বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে সব মাধ্যমে সিনেমাগুলোর প্রচার করে। অনেক পরিবারই ঈদের সময় দল বেঁধে সিনেমা দেখেন।’
ওই পরিচালকের কথা, সিনেপ্লেক্সে একাধিক ছবি মুক্তি পায়। দর্শক যে ছবিটি দেখার জন্য হলে যাচ্ছেন, অনেক সময় টিকিট না পেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরেকটি ছবি দেখছেন। এতে করে ওই সব ছবিও কিছু দর্শক পাচ্ছে। পুঁজি ফেরত না এলেও ঈদের সফল ছবির পাশাপাশি অন্তত দুই সপ্তাহ আলোচনায় থাকছে ব্যর্থ ছবিগুলোও। কিন্তু অন্য সময় মুক্তি দিলে আলোচনা তো দূরের কথা, মুক্তির কয়েক দিনের মাথায় প্রেক্ষাগৃহে মুখ থুবড়ে পড়ছে।’
সারা বছর দর্শক নেই
গত কয়েক বছরে ঈদ ছাড়া অন্য সময় মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো সেভাবে ব্যবসাসফল হতে পারেনি। ২০২৩ সালে ৫০টির মতো সিনেমা মুক্তি পায়। ২০২২ সালে মুক্তি পায় ৩০টি ছবি। এ দুই বছরে উৎসব ছাড়া অন্য সময়ে মুক্তি পাওয়া বড় বাজেটের সিনেমাও মোটাদাগে ব্যর্থ হয়েছে। পরিচালক শাহিন সুমন মনে করেন, ২০১৬ সালের পর থেকেই প্রেক্ষাগৃহে সিনেমার হিসাব–নিকাশ পরিবর্তিত হতে শুরু করে। তিনি বলেন, ‘বহু বছর ধরে আমি সিনেমা নির্মাণ করে আসছি। কিন্তু কখনোই ভাবিনি, আমাদের সিনেমা ঈদকেন্দ্রিক হয়ে যাবে। একটা সময় দেখেছি, সারা বছরই প্রেক্ষাগৃহে নতুন নতুন সিনেমায় দর্শকের জোয়ার। এখন সেটি ইতিহাস মনে হয়।’
তাহলে এখন সেই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে না কেন? এই পরিচালকের ভাষ্য, ‘কোভিড আমাদের দর্শকের অনেকটাই হলবিমুখ করেছে, আত্মকেন্দ্রিক করেছে। সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অভ্যাস নষ্ট করে দিয়েছে। আরও একটি ব্যাপার, আপনি কি এটা শুনেছেন, অন্য সময়ে মুক্তি পাওয়া ভালো গল্প, ভালো নির্মাণের ছবি মুক্তি পেয়েছে কিন্তু দর্শক দেখেনি? তার মানে গল্প, নির্মাণও এখানে একটি ব্যাপার। সারা বছরও ভালো ছবি দিতে হবে।’
বছরের অন্য সময়ে সিনেমা না চলার পেছনে মানহীন সিনেমা তৈরির প্রবণতাকে দায়ী করলেন প্রযোজক ও প্রদর্শক সমিতির নেতা ইফতেখারুদ্দিন নওশাদ। তিনি বলেন, ‘হাতে গোনা ছবি ছাড়া সারা বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত বেশির ভাগ ছবিই মানহীন। চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জানার কারণে নতুন প্রযোজকেরা সেটি বুঝতে পারছেন না। পরিচালকের ওপর ভরসা করে মূলধন হারাচ্ছেন তাঁরা। মূলত পেশাদার প্রযোজকের অভাবেই এটি হচ্ছে।’
ঈদের এত ছবি কোথায় চলবে
প্রদর্শক সমিতির হিসাবমতে, এখন ৬০টির মতো একক হল আছে। ঈদের সময় সেটি বেড়ে ১২০টি হতে পারে। সঙ্গে আছে মাল্টিপ্লেক্সে ৩৫টি হল। শেষ পর্যন্ত যদি ১০টি ছবিও মুক্তি পায়, হল ভাগাভাগিতে ছবিগুলো কটি করে হল পাবে? এ প্রসঙ্গে ইফতেখারুদ্দিন নওশাদ বলেন, ‘এত ছবি মুক্তি পেলে কোনো ছবিই ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারবে না। দেখা গেল, ১০টি ছবির মধ্যে ২টি ছবি হিট হয়ে গেল। ব্যর্থ ছবিগুলো না এলে হিট ছবি দুটি আরও বেশি হল পেত। আয়ও বেশি হতো। অন্যদিকে ব্যর্থ হওয়া ছবিগুলো ঈদের তিন-চার সপ্তাহ পর চালালেও কিছু টাকা আসত। হিট ছবির প্রভাব অন্য সিনেমাগুলোতেও পড়ত। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। সব ছবিরই ক্ষতি হচ্ছে।’