বাবুবাজারে শর্ত ভেঙে দোকান, মাসে তোলা হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা
পুরান ঢাকার দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু (বাবুবাজার ব্রিজ) নিচের নির্ধারিত জায়গা ইজারা দেওয়া হয়েছিল কেবল গাড়ি পার্ক করার জন্য। ইজারার শর্ত ছিল সেখানে হকার বসতে পারবে না। পার্কিং ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসা করলে ইজারা বাতিল হবে বলেও শর্ত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গাড়ি পার্কিংয়ের নামে ইজারা নেওয়ার পর ওই জায়গাটিকে রীতিমতো ব্যবসাকেন্দ্র বানিয়ে বাণিজ্য করা হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুল মান্নানের ছত্রচ্ছায়ায় এই বাণিজ্য চলছে। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে বাবুবাজার ব্রিজের নিচে দোকানপাট বসিয়ে ও পার্কিং থেকে মাসে কমবেশি ৩০ লাখ টাকা তুলছেন কাউন্সিলরের অনুসারীরা। এই টাকার ভাগ পাচ্ছে পুলিশও।
বাবুবাজার ব্রিজের নিচের সড়কটি পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল, ইসলামপুর, বাদামতলী, চকবাজার ও সদরঘাটে যাওয়ার অন্যতম পথ। সড়ক ও ফুটপাত দখল করে বাণিজ্য করার কারণে প্রায়ই ওই পথে যানজট লেগে থাকে।
নয়টি ব্লকের নিচে ৮০টি মাস্কের দোকান, ২৫টি অস্থায়ী ফলের দোকান, ২৪টি কাপড়ের দোকান, ৯টি ভাতের হোটেল, ১৯টি চায়ের দোকান, রিকশা ও ভ্যানের গ্যারেজ, জুস ও খিচুড়ির দোকান, ১০টি পুরোনো মোবাইলের দোকান বসানো হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সকালে বাবুবাজার ব্রিজের নিচে যানজটে আধা ঘণ্টার বেশি আটকে ছিলেন ধানমন্ডির বাসিন্দা আবদুল কাদের। মিটফোর্ড হাসপাতালে তিনি স্বজনকে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, যত্রতত্র দোকান বসানোর কারণে রাস্তা সংকুচিত হয়ে গেছে। এর মধ্যে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে মালামাল নামানো হচ্ছিল। এসব কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়।
ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র বলছে, বাবুবাজার ব্রিজের নিচে ২৮ হাজার বর্গফুট খোলা জায়গা গাড়ি পার্ক করতে এক বছরের জন্য ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। ইজারামূল্যের পাশাপাশি ভ্যাট বাবদ ১১ লাখ টাকা ও আয়কর বাবদ আরও ৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা করপোরেশনকে দিতে হয়েছে। ইজারা নিয়েছেন বাবুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি।
বাবুবাজার সেতুর নিচের অংশে সেতুর এক পিলার থেকে অন্য পিলার পর্যন্ত অংশকে একটি ব্লক বলা হয়। সেখানে নয়টি ব্লকের নিচে ৮০টি মাস্কের দোকান, ২৫টি অস্থায়ী ফলের দোকান, ২৪টি কাপড়ের দোকান, ৯টি ভাতের হোটেল, ১৯টি চায়ের দোকান, রিকশা ও ভ্যানের গ্যারেজ, জুস ও খিচুড়ির দোকান, ১০টি পুরোনো মোবাইলের দোকান বসানো হয়েছে।
বাবুবাজার ব্রিজের নিচের সড়ক ও ফুটপাত দখল করে বাণিজ্য করার বিষয়ে তাঁরা অবগত। অভিযোগ পেয়ে তাঁরা সেখানে অসংখ্যবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছেন। প্রয়োজনে আবার সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।
ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্টেট মো. মুনিরুজ্জামান
বাবুবাজারের ওই জায়গা থেকে টাকা তোলার কাজে যুক্ত দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাস্ক ও কাপড়ের দোকান থেকে দৈনিক ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, ফলের দোকানপ্রতি দৈনিক ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, ভাতের হোটেল থেকে দৈনিক ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, চায়ের দোকান থেকে দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ টাকা ভাড়া তোলা হয়। কাউন্সিলরের ভাই জাবেদ হোসেন, বন্ধু মো. তসলিম, যুবলীগের স্থানীয় নেতা রুবেল গাজী, হৃদয় হোসেন, মো. পিন্চু দোকানভাড়ার টাকা তোলার কাজে নেতৃত্ব দেন।
বাবুবাজার সেতুর নিচে ইজারাদারের মূল ব্যবসা পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন পরিবহনের কাছ থেকে টাকা আদায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনটি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গাড়ি তিনটি হোক বা চারটি হোক, দৈনিক ইজারাদারকে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। অবশ্য সিটি করপোরেশন পার্কিং করার ক্ষেত্রে যে ফি নির্ধারণ করে দিয়েছিল, তা হচ্ছে গাড়ি পার্কিংয়ে প্রথম ঘণ্টা ২০ টাকা, পরবর্তী প্রতি ঘণ্টা ১০ টাকা। একটি গাড়ি যদি ২৪ ঘণ্টা সেখানে রাখা হয়, তাহলে ইজারাদারকে ২৫০ টাকা দেওয়ার কথা।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশন ইজারাদারকে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত গাড়ি পার্কিংয়ের সময়সীমা দিলেও ২৪ ঘণ্টাই ওই জায়গা কোনো না কোনো কাজে ভাড়া দিয়ে বাণিজ্য করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ভাষ্য, দোকান, ভ্যান ও রিকশার গ্যারেজ, ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি ও মালামাল ওঠানো–নামানো—এসব খাতে দৈনিক সোয়া দুই লাখ টাকার মতো তোলা হয়। এর মধ্যে ইজারাদার নিজে রাখেন প্রায় এক লাখ টাকা। বাকি টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করে দেন।
ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ ও স্থানীয় দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাবুল হোসেনের নামে ইজারা নেওয়া হলেও বেশির ভাগ বিনিয়োগ কাউন্সিলরের।
ইজারাদার বাবুল হোসেন অবশ্য দাবি করেছেন, ইজারার সঙ্গে কাউন্সিলর সম্পৃক্ত নন। তবে কাউন্সিলরের কাছের লোকদের সঙ্গে নিয়েই তিনি ইজারা নিয়েছেন। এতে সবারই বিনিয়োগ আছে। পার্কিংয়ের নামে ইজারা নিয়ে অন্য ব্যবসা করার বিষয়টি সিটি করপোরেশনের লোকদের জানানো হয়েছে। মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে এভাবে বাণিজ্য করার বিষয়ে বাবুল হোসেন বলেন, রাস্তায় যাতে যানজট না বাধে, সেদিক বিবেচনায় নিয়েই তাঁরা ব্যবসা করছেন।
ইজারার শর্ত ভেঙে বাণিজ্য করার বিষয়ে জানতে কাউন্সিলর আবদুল মান্নানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও জবাব দেননি তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসির দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর আগেও একই জায়গার ইজারা দেওয়া হয়েছিল ৩৬ লাখ টাকায়। ওই জায়গার ইজারা নিয়ে দুটি পক্ষ আছে। প্রতিযোগিতা করে ইজারামূল্য তারা প্রায় দ্বিগুণ করেছে। এখন এসব টাকা তুলতেই সড়কের দোকানপাট বসানো থেকে শুরু করে নানা ধরনের বাণিজ্য চালু হয়েছে।
ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ কঠোর অবস্থানে থাকলে ইজারাদার রাস্তায় যানজট সৃষ্টি করে বাণিজ্য করতে পারতেন না। তাঁরাও শুনেছেন এই বাণিজ্য থেকে পুলিশও ভাগ পাচ্ছে।
তবে পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান মিয়া। তিনি বলেন, পুলিশ কোনোভাবেই এসব ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্টেট মো. মুনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বাবুবাজার ব্রিজের নিচের সড়ক ও ফুটপাত দখল করে বাণিজ্য করার বিষয়ে তাঁরা অবগত। অভিযোগ পেয়ে তাঁরা সেখানে অসংখ্যবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছেন। প্রয়োজনে আবার সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।