Home রাজনীতি ফের ভাঙনের পথে জাপা
ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৪

ফের ভাঙনের পথে জাপা

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) সৃষ্ট বিভাজন-রেখার প্রস্থ দিন দিন চওড়া হচ্ছে। নেতাকর্মীদের বৃহদাংশের ক্ষোভ-অসন্তোষের পটভূমিতে নতুন করে সামনে এসেছেন দলটির জ্যেষ্ঠতম নেতা ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। জাপার চেয়ারম্যান পদ থেকে জি এম কাদেরকে এবং মহাসচিব থেকে মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়ে গত ২৮ জানুয়ারি তিনি নিজেই নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। এখানেই থামেননি। আগামী ৯ মার্চ দলের জাতীয় কাউন্সিল করারও ঘোষণা দিয়েছেন। এবার বললেন, ‘জাপা এখন চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। সবাই মিলে সুন্দর একটি সম্মেলন উপহার দিয়ে জাপায় আবার প্রাণশক্তি ফিরিয়ে আনতে চাই।’

জাপার দায়িত্বশীল নেতাদের মতে, সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলে সৃষ্ট এই বিভক্তি শেষ পর্যন্ত আরেক দফা ভাঙনের মুখে ফেলতে পারে প্রয়াত এইচ এম এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাপাকে। এবারের নির্বাচন থেকে রওশন এরশাদ ও তার ছেলে রাহ্গীর আল মাহি (সাদ এরশাদ) এবং রওশন-অনুসারীরা ছিটকে পড়ায় বিভক্তি-রেখা মোছার সম্ভাবনা কম। ফলে, দিন যত গড়াচ্ছে- জাপার আরেক দফা ভাঙনের আলামত ততোই স্পষ্ট হচ্ছে। আর সেটির চূড়ান্ত রূপ দেখা যেতে পারে আসছে ৯ মার্চ।

রওশনের পাশে ফিরোজ রশীদ ও বাবলা

গতকাল রবিবার সকালে রাজধানীর গুলশানে নিজ বাড়ির নিচে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ৯ মার্চ কাউন্সিল করার অনড় অবস্থান জানান দেন রওশন। ‘সংবাদ সম্মেলন ও শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে রওশনের ডানের চেয়ারে ছিলেন জাপা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত কো-চেয়ারম্যান থাকা কাজী ফিরোজ রশীদ। বামে ছিলেন দলের আরেক কো-চেয়ারম্যান এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জাপার সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। রওশনপুত্র সাদ এরশাদও ছিলেন।

৭ জানুয়ারির নির্বাচনের দুই দিন পর থেকেই কাজী ফিরোজ রশীদ ও বাবলা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিক্ষুব্ধদের কাতারে থাকলেও এতদিন রওশন-বলয়ে তারা দুজন প্রকাশ্যে আসেননি। গতকালই প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে এলেন দলটির শীর্ষস্থানীয় এই দুই নেতা। রওশনের পাশে থাকা ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘বাজার পরিস্থিতিসহ নানা বিপর্যয় নিয়ে সংসদে দলের (জাপা) যারা আছেন, তারা কথা বলেন না, একতারা বাজিয়ে গান গান। জাপার ৯ মার্চের কাউন্সিল অতীতের সকল কাউন্সিলের চেয়ে সুসংগঠিত হবে।’

রওশনের বামের চেয়ারে বসা বাবলা বললেন, ‘রওশনের নেতৃত্বে নতুন উদ্যমে জাপা গঠন করব। সারা দেশে ওয়ার্ড ও ইউনিট পর্যায়ে দলকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করব। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পঁচা মাংস ফেলে দিয়ে নতুন জাতীয় পার্টি তৈরি হবে। বাবলা বলেন, ‘এতদিন আমরা জানতাম- ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়; এখন দেখছি- দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়, আর ব্যক্তির চেয়েও স্ত্রী বড়।’

অব্যাহতির পর বাবলা বললেন, ‘ডোন্ট কেয়ার’

সকালে রওশন-বলয়ে ভিড়ে এই বক্তব্য দেওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যেই বিকালে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাকে দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। জাপার যুগ্ম-দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম স্বাক্ষরিত এসংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের দলীয় গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলাকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান পদসহ দলীয় সকল পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি প্রদান করেছেন। যা ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে।’

অব্যাহতির বিষয়ে বাবলা ইত্তেফাককে বলেন, ‘ড্যামকেয়ার। এটা এরশাদের দল, তার স্ত্রী রওশন এরশাদ দলের প্রধান অভিভাবক। এখানে অন্য কেউ কাউকে অব্যাহতি দেওয়ার কোনো এখিতয়ার রাখেন না। সুতরাং কে আমাকে অব্যাহতি দিল কী দিল না, আই ডোন্ট কেয়ার। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে অখণ্ডিত জাপার আমি কো-চেয়ারম্যান ছিলাম, এখনো আছি।’

ফিরোজ-সুনীল-সেন্টুর পর বাবলা

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬টি আসনে সমঝোতা করে নির্বাচনে যাওয়া, সেই ২৬টির মধ্যে ১১টি আসনে জয়ী হওয়া, দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েক নেতার আসনে সমঝোতা করতে না পারা এবং সমঝোতার বাইরে যারা দলীয় প্রার্থী ছিলেন, তাদের খোঁজ না রাখাসহ কয়েকটি কারণে দলের নেতাকর্মীদের একটি অংশ গত ১০ জানুয়ারি বিক্ষোভ করেন জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে। এর জেরে কয়েক দিনের ব্যবধানে জাপা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় ও শফিকুল ইসলাম সেন্টু এবং ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহ্ইয়া চৌধুরীকে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের আরও কয়েক জনকেও দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অব্যাহতিপ্রাপ্তদের তালিকায় গতকাল যুক্ত হলেন সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। এছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর জাপার সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টুর নেতৃত্বে সম্প্রতি মহানগরী উত্তরের বিভিন্ন ওয়ার্ডের কয়েক জন নেতা পদত্যাগ করেছেন।

এরশাদভক্ত অগণিত নেতাকর্মী আমার পাশে: রওশন

সকালে নিজবাড়িতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্যে রওশন এরশাদ বলেন, আজ আমার দু’পাশে রয়েছেন কাজী ফিরোজ রশীদ ও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, তারা জাপা ও বাংলাদেশের রাজনীতির দুই দিকপাল। এই দুই নেতা জাপার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অনন্য ভূমিকা পালন করছেন। পার্টির জন্য তারা জেলজুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। এরশাদ ও আমার পাশে তারা সব সময়ই ছিলেন, এখনো আছেন।

তিনি বলেন, জাপার চরম বিপর্যয় অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবং পার্টিকে আবার সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে নেতাকর্মীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করে আগামী ৯ মার্চ দশম জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছি। ফিরোজ রশীদ ও বাবলাসহ পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতৃবৃন্দ এবং এরশাদভক্ত সর্বস্তরের অগণিত নেতাকর্মী আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন।

রওশন এরশাদ আরও বলেন, একটি রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্র চর্চার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে—সময়মতো পার্টির জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান। জাপার সম্মেলন আয়োজনের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।

সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ফিরোজ, কো-আহ্বায়ক বাবলা

সংবাদ সম্মেলনে রওশন এরশাদ তার ডাকা কাউন্সিল সফল করতে একটি সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটিও ঘোষণা করেন। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ফিরোজ রশীদকে, আর কো-আহ্বায়ক বাবলা এবং সদস্যসচিব শফিকুল ইসলাম সেন্টু। প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাপার বর্তমান কমিটির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ হয়েছে।

এটা জাপার কাউন্সিল নয়, তারা চাইলে নতুন দল করতে পারেন: চুন্নু

রওশনের কাউন্সিল ডাকার বিষয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আমাদের দলের কোনো কাউন্সিল ডাকিনি। বাইরের কে কাউন্সিল ডাকল না ডাকল, তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক  নেই। ওনারা দল করতে পারেন, ১০টা কাউন্সিল করতে পারেন, ১০টা কমিটিও করতে পারেন—সেটা ওনাদের বিষয়। এর সঙ্গে জাপার কোনো সম্পর্ক নেই। কাজেই এটা জাপার কোনো কাউন্সিল নয়। জাতীয় পার্টি নামে চার-পাঁচটা গ্রুপ আছে। জাতীয় পার্টি ব্র্যাকেটে অমুক-তমুক ইত্যাদি নামে তারা চাইলে নতুন দল করতে পারেন, সেখানে আমাদের বাধা দেওয়ার কিছু নেই। নতুন একটা দল হতেই পারে। সবারই স্বাধীনতা আছে। তবে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে যে দল আছে, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১২, এটা ঠিক আছে।’

জাপার কাউন্সিলের মেয়াদ উত্তীর্ণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি সময় হলে আমাদের সম্মেলন করব। মেয়াদ শেষ হলেও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে আবেদন করে সময় নেওয়া যায়। আমরা সেই সময় নিয়েছি, আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সময় আছে।’ সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার বিষয়ে চুন্নু বলেন, তিনি যদি নতুন কোনো দলে যুক্ত হতে চান, তাহলে তার উচিত ছিল নিজ থেকে পদত্যাগ করে সেখানে যাওয়া। কিন্তু উনি যেহেতু অন্য একটা দলে যাওয়ার চিন্তা করেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন, এটা দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাপা মহাসচিব বলেন, পার্টি ছেড়ে অনেকের চলে যাওয়ার সঙ্গে মূল্যায়নের কিছু নেই। একটা দল থেকে অনেকেই চলে যেতে পারেন। এতে ভালো হতে পারে, মন্দও হতে পারে। এক সময় বিএনপি ছেড়েও অনেকে চলে গেছে। খালেদা জিয়া হাউজ ওয়াইফ ছিলেন, অনেকে ভেবেছেন দল টিকবে না। কিন্তু বিএনপি টিকে গেছে। এখন আমার মতো সিনিয়র নেতারা চলে গেলেই দল টিকবে না, এমনটা এখনই বলা যাচ্ছে না। ভবিষ্যৎ সব বলে দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *