Home বিনোদন সালমান শাহর মৃত্যুতে পরিচালকেরা দিশাহারা, এলেন মান্না…
ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৪

সালমান শাহর মৃত্যুতে পরিচালকেরা দিশাহারা, এলেন মান্না…

তরুণ মন কত কী যে হতে স্বপ্ন দেখে! কেউ কেউ সেই স্বপ্ন বুকে লালন করে আগামীর পথে চলা শুরু করেন। পথ চলতে চলতে একটা সময় স্বপ্নের ভেলা নোঙর করে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। তেমনই এক স্বপ্নবান তরুণ পেয়েছিল ঢালিউড, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন নায়ক হওয়ার। হয়েছেনও তা–ই। পেয়েছিলেন তুমুল জনপ্রিয়তা। অভিনয় দিয়ে বাংলার মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন গণমানুষের নায়ক। তাঁর পুরো নাম এস এম আসলাম তালুকদার। বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে যাঁদের কিছুটা যোগাযোগ আছে, তাঁরা এ মানুষটিকে মান্না নামেই চেনেন। মৃত্যুর ১৬ বছর পার হতে চললেও মানুষের মনে তাঁর অবস্থান বদলায়নি। তাঁর অভিনীত ছবিগুলো তাঁকে ছবিপ্রেমী মানুষের মনে জীবন্ত করে রেখেছে।

সত্যি বলতে, জগতে কিছু মানুষ থাকেন, মৃত্যুর পর তাঁরা যেন আরও বেশি ভালোবাসায় সবার হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তাঁদের মৃত্যু হয় না। মানুষের মনে চিরকাল অমর হয়েই থাকেন। তারকাদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি সবচেয়ে বেশি ঘটে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তেমনই একজন মান্না। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে জন্ম নেওয়া আসলাম তালুকদারের ছোটবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। কলেজে পড়ার সময় প্রচুর সিনেমা দেখতেন। নায়ক রাজ্জাকের সিনেমা হলে তো কথাই নেই। স্বপ্ন দেখতেন তিনিও একদিন অভিনয় করবেন। ছোটবেলায় অনেকের ইচ্ছা থাকে চিকিৎসক ও প্রকৌশলী হওয়ার; কিন্তু মান্নার ইচ্ছা ছিল তিনি নায়ক হবেন। একদিন বলাকায় সিনেমা দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ বিজ্ঞাপন। তারপর টিভি আর পত্রিকায় দেখে বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি ইন্টারভিউ দেন। সুযোগও পেয়ে যান।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাসের পরই ১৯৮৪ সালে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমের মাধ্যমে চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখেন এস এম আসলাম তালুকদার। টাঙ্গাইলের সেই কিশোর হয়তো তখনো জানতেন না যে তিনিই একদিন হয়ে উঠবেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক।

শুধু তা-ই নয়, ঢাকাই চলচ্চিত্রের একজন নির্ভরযোগ্য নায়ক হবেন তিনি। ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমে সুযোগ পেয়েই কিন্তু আসলাম থেকে নায়ক মান্না হতে পারেননি তিনি। এর জন্য অনেক ত্যাগ, অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে তাঁকে। এফডিসির অফিস পাড়ায় ঘোরাঘুরি আর নিয়মিত পরিচালকদের কাছে ধরনা দিতে হতো। যে রাজ্জাককে দেখে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বপ্ন দেখার শুরু, সেই রাজ্জাকই একসময় তাঁকে সুযোগ করে দেন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের।

চিত্রনায়ক মান্না
চিত্রনায়ক মান্না

১৯৮৬ সালে ‘নায়করাজ’ রাজ্জাকের এক বন্ধুর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত ‘তওবা’ সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ হয় মান্নার। আর এভাবেই শুরু হয় নায়ক মান্নার চলচ্চিত্রজীবনের যাত্রা। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে আসলাম তালুকদার নাম পাল্টে হয়ে ওঠেন ‘মান্না’। শুরুতে একের পর এক অ্যান্টি–হিরো হিসেবে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সে সময় তেমন সাফল্য আনতে পারেননি। আশির দশকে মান্না যখন ছবিতে অভিনয় শুরু করেন, সে সময় রাজ্জাক, আলমগীর, জসীম, ফারুক, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চনের নায়ক হিসেবে বেশ দাপট। সেই দাপুটে অভিনেতাদের মাঝেও ‘তওবা’, ‘পাগলী’, ‘ছেলে কার’, ‘নিষ্পাপ’, ‘পালকি’, ‘দুঃখিনী মা’, ‘বাদশা ভাই’-এর মতো ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিয়েছেন মান্না। দুঃখজনক হচ্ছে, এসব ছবির কোনোটিতেই মান্না প্রধান নায়ক ছিলেন না। তাই সাফল্যের ভাগীদার খুব একটা হতে পারতেন না।

মান্না অভিনীত প্রথম ছবি ‘তওবা’ হলেও প্রথম ছবি হিসেবে যে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল, তার নাম ‘পাগলী’। ১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘কাশেম মালার প্রেম’ ছবিতে প্রথম একক নায়ক হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন মান্না। এ ছবিটি সুপারডুপার হিট হওয়ার কারণে একের পর এক একক ছবিতে কাজ করার সুযোগ পান মান্না। এরপর কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ ও ‘ত্রাস’ ছবির কারণে তাঁর একক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ হয়ে যায়। এরপর আরও কয়েকটি ব্যবসাসফল ছবি উপহার দেন মান্না। দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘গরীবের বন্ধু’ ছবির পর একটু ধীরে এগোতে থাকেন মান্না। সে সময় মান্নাকে নিয়ে সবার আগ্রহ তৈরি হয়। সবাই তাঁকে নিয়ে ছবি বানাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রের প্রযোজক-পরিচালকেরাও তাঁর কাছে নির্ভরতা খুঁজে পান।

 চিত্রনায়ক মান্না
চিত্রনায়ক মান্না

নব্বই দশকের শুরুতে নাঈম-শাবনাজ, সালমান শাহ-শাবনূর, ওমর সানী-মৌসুমী জুটি বেশ সফল। তাঁদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যান মান্না। মনতাজুর রহমান আকবর, কাজী হায়াত, নূর হোসেন বলাই, নাদিম মাহমুদ, এম এ মালেক, এফ আই মানিক, মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, এ জে রানা, বেলাল আহমেদের মতো পরিচালকের ছবি দিয়ে মান্না নিজেকে প্রমাণ করতে থাকেন। পরিচালকেরা তাঁর প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করেন।

১৯৯৬ সালে সালমান শাহর হঠাৎ মৃত্যুতে প্রযোজক-পরিচালকেরা দিশাহারা হয়ে যান। কারণ, তখন সালমান শাহর ওপর বিনিয়োগ ছিল অনেক বেশি। এ সময় পরিচালকদের চোখে একমাত্র আস্থার নায়ক হিসেবে মান্না ধরা দেন। মান্নাও পুরো চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার মতো কঠিন দায়িত্বটি নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেন। ১৯৯৭ সালে নায়ক থেকে প্রযোজনায়ও আসেন মান্না। মান্নার প্রথম ছবি ‘লুটতরাজ’ সুপারহিট ব্যবসা করে। এরপর বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে শুরু হয় মান্না-অধ্যায়। একের পর এক মুক্তি পেতে থাকে মান্না অভিনীত বেশ কয়েকটি ছবি। বেশির ভাগ ছবিই দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়িক সফলতাও পায়। সবাই মান্নাকে নিয়ে একের পর এক ছবি বানাতে থাকেন। প্রযোজক-পরিচালকেরা তাঁর মধ্যে খুঁজে পান নতুন আশার আলো। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে যত ছবি প্রযোজনা করেছেন, প্রতিটি ব্যবসাসফল হয়েছিল। ছবিগুলো হলো ‘লুটতরাজ’, ‘লাল বাদশা’, ‘আব্বাজান’, ‘স্বামী–স্ত্রীর যুদ্ধ’, ‘দুই বধূ এক স্বামী’, ‘মনের সাথে যুদ্ধ’ ও ‘মান্না ভাই’।

সালমান শাহ্
সালমান শাহ্ইনস্টাগ্রাম

অল্প সময়ে নায়ক হিসেবে মান্না কীভাবে এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন—এমন প্রশ্নে দেশের চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সবাই একটি জায়গায় একমত ছিলেন যে দর্শকদের খুব চেনা মনে হতো মান্নাকে। তথাকথিত সুদর্শন এবং ‘শুদ্ধ’ ভাষার ও নম্র সুরে কথা বলা ভালো ছাত্র ও ভদ্রলোকের চরিত্রে নয়, বরং মান্নার প্রায় সব সিনেমায় দর্শক মান্নাকে পেয়েছেন ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায়। কোনো সিনেমায় মান্না সন্ত্রাসী লালনকারী রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সৎ পুলিশ কর্মকর্তা, কোনো সিনেমায় অসৎ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বস্তি রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিবাদী যুবক, কখনো ধনীর ধন কেড়ে এনে গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া রবিনহুড। পর্দায় তাঁকে দেখা গেছে ধর্ষককে খুন করতে। কুচক্রী প্রভাবশালীদের দমাতে। এসব দেখে সমাজের অসহায় শ্রেণির দর্শকেরা সাময়িক শান্তি পেয়েছেন, আনন্দ পেয়েছেন। বাস্তবে তাঁরা যা করতে পারেন না, পর্দায় তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে মান্না সেসব করে দেখিয়েছেন। মান্না যেন নিম্নবর্গের দর্শকের কাছে তাঁদের একমাত্র কণ্ঠস্বর।

স্বাধীনতার পর প্রায় নব্বই দশক পর্যন্ত ঢাকার বেশির ভাগ সিনেমার নায়কেরা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পরীক্ষায় ভালো ফল করে, ভালো চাকরি করতেন। কিন্তু মান্নার চরিত্রগুলো সে রকম ছিল না। তাঁর চরিত্রটি ছিল বরং উঁচু আওয়াজের খ্যাপাটে যুবকের। প্রায়ই সংলাপে থাকত খিস্তিখেউড়, আচরণে অস্থিরতা। বড় ডিগ্রি নিয়ে বড় চাকরি নয়, পর্দায় তাঁর সাফল্যের মাপকাঠি ছিল সমাজের অন্যায়কারীদের পরাজিত করা। মূলত এসব কারণেই খুব সহজে মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন মান্না।

চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র-বিষয়ক নানা কর্মকাণ্ডেও মান্নার ছিল অগ্রণী ভূমিকা। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে হঠাৎ অশ্লীলতা জেঁকে বসলে হাল ধরেন মান্না। দেশের আনাচকানাচ চলছিল অশ্লীল ছবি। একশ্রেণির প্রযোজক, পরিচালক ও কিছুসংখ্যক অভিনয় না জানা অভিনয়কুশলীর অযৌক্তিক অশ্লীলতাসর্বস্ব ছবিগুলোর প্রতি আকর্ষণ ছিল স্কুলপড়ুয়া ছেলেদেরও। কিংবা কোনো ভালো ছবির মধ্যে ‘কাটপিস’ নামক দৃশ্য ঢুকিয়ে দর্শকদের আমোদ দিতে চেয়েছেন কেউ কেউ। সে সময় মান্না রীতিমতো যুদ্ধ করেছেন অশ্লীল চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে। এসব চলচ্চিত্রের নির্মাতাদের সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিলেন। সে সময় একমাত্র নায়ক মান্নার ছবিগুলোই ছিল প্রযোজক ও পরিচালকদের আশার আলো, ব্যবসায় টিকে থাকার সাহস। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মান্না একাই লড়ে গেছেন।

আশির দশকে সুনেত্রা, নিপা মোনালিসা থেকে শুরু করে চম্পা, দিতি, রোজিনা, নূতন, অরুণা বিশ্বাস, কবিতার মতো সিনিয়র নায়িকাদের সঙ্গে অভিনয় করে যেমন সফল হয়েছিলেন, তেমনি মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমা, মুনমুন, সাথী, স্বাগতা, শিল্পী, লিমাদের সঙ্গে তাঁর ছবি ব্যবসায়িক সফলতা পেয়েছে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অভিনয়, সংলাপ বলার ধরন দিয়ে নিজস্ব একটা স্টাইল দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। তাঁর অভিনীত এমন কিছু ছবি আছে, যার জন্য তিনি আজীবন দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। একটা সময় ছিল, যখন ছবিতে শুধু মান্না আছেন‍—এ কারণেই দর্শক হলে ছুটে গেছেন, তাঁর কারণেই ছবি ব্যবসাসফল হয়েছে। মান্না যে ছবিতে, সেই ছবির কাহিনি যত গতানুগতিকই হোক না কেন, সেই ছবি ব্যবসা করবেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটনির্ভর ছবিতেও মান্না ছিলেন অনবদ্য।

ঠিক ১৬ বছর আগে এই দিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান নায়ক মান্না। ঘটনাটি ঘটেছিল আকস্মিকভাবেই। অসময়ে প্যাকআপ হলো শুটিং। ঢালিউডকে দুঃসময়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে সেই যে চলে গেলেন মান্না। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ। রাতে শুটিং শেষ করে বাড়ি ফিরতেই বুকে উঠল চিনচিন ব্যথা। গৃহ সহকারী মিন্টু পানি এনে খাওয়ালেন মান্নাকে। একটু হাঁটাহাঁটি করে পরে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ভোর সাড়ে চারটার দিকে আবার সেই ব্যথা। মিন্টুকে ঘুম থেকে তুলে নায়ক মান্না বললেন, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। হাসপাতালে যাব। বুকের ব্যথাটা বাড়ছে।’ নিজেই গাড়ি চালিয়ে উত্তরা থেকে যান গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে। কিন্তু ফেরেন প্রাণহীন হয়ে। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মান্না। হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ইহজাগতিক ভ্রমণ শেষ হয় ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়ক মান্নার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *