বিবর্তনে ডারউইনের তত্ত্ব এখন জীবজগতের বাইরেও
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি অঙ্গরাজ্য, ১৮০৯ সাল। কর্নেল স্যান্ডার্সের কেনটাকি ফ্রাইড চিকেন বা কেএফসি বাজারে আসতে তখনও ১৪৩ বছর বাকি। সে সময়ে কেনটাকির রুক্ষ এক কাঠের লগ কেবিনে যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল, কেউ জানত না এই শিশু বড় হয়ে মানবাধিকারের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলবেন। শিশুটির নাম ছিল এব্রাহাম লিঙ্কন। জন্ম তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি।
তবে, এই গল্পটি কৃতদাস প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য পরিচিত ষোড়শ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে নয়। বরং ওই একই দিনে কেনটাকি থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার পূর্বে ইংল্যান্ডের প্রাচীন শহর শ্রুজব্রি বা শ্রোউজব্রি শহরের এক ধনী পরিবারে জন্ম নেওয়া ভিন্ন এক শিশুকে নিয়ে।
জন্মেছিলেন ধনী পরিবারে, অথচ দিকহারা নাবিকের মত ঘুরে বেরিয়েছেন সাগর থেকে সাগরে, সংগ্রহ করেছেন অজস্র নমুনা। হতে চেয়েছিলেন পাদ্রী। তবে, শেষ পর্যন্ত ধর্মের একেবারে বিপরীতে গিয়ে দাঁড় করিয়েছেন প্রাণীজগতের সবচেয়ে বৈপ্লবিক ধারণা।
শিশুটির নাম ছিল চার্লস রবার্ট ডারউইন। সোমবার পালিত হচ্ছে তার ২১৫তম জন্মবার্ষিকী।
বিবর্তনবাদে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রবক্তা ডারউইন একশ ৬৫ বছর আগে এ যুগান্তকারী ধারণা দিয়েছিলেন নিজের ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিশিস’ বইটিতে।
এতে তিনি বলেছেন, কোনো প্রাণী ক্রমাগত অভিযোজনের ফলে নিজ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে এক সময় নতুন প্রজাতি তৈরি করে।
ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিষয়টি আজ প্রায় সবারই জানা। তবে সেগুলো বেশ পুরনো কথা। ১৮৫৯ সালে অর্থাৎ ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ তত্ত্ব দিয়েছিলেন ডারউইন। এর দুই শতক পর ডারউইন বা তার তত্ত্ব কি আজও প্রাসঙ্গিক?
মূলত, বিবর্তন নিয়ে ডারউইনের পর্যবেক্ষণ সারা পৃথিবী ঘুরে নমুনা আর তথ্য সংগ্রহ করে নিজ বাড়িতে ফিরে প্রায় দুই দশক ধরে করা পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে।
চার্লস ডারউইনের দেওয়া প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বে তিনটি মূল বিষয় ছিল: একটি প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে এলোমেলোভাবে এ ভিন্নতা ঘটেছে; যে কোনো প্রাণীর আচরণগত বৈশিষ্ট্য তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে আসতে যেতে পারে; আর অস্তিত্বের সংগ্রামের ক্ষেত্রে পরিবেশের অনুকূলে থাকা প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি।
পাশাপাশি, ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে একুশ শতকে এমন বেশ কিছু ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখা গেছে, যা তিনি নিজেই সম্ভবত কখনও কল্পনাও করেননি।
চিকিৎসা
এভোলিউশনারি মেডিসিন বা বিবর্তনীয় চিকিৎসার উদীয়মান খাত মানুষকে ধারণা দিয়েছে, আমরা কেন অসুস্থ হই ও কীভাবে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও অন্যান্য রোগ জীবাণুর চলমান বিবর্তনে বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসা করা সম্ভব।
উদাহরণ হিসাবে, মৌসুমী ফ্লুকে বিবেচনা করা যেতে পারে। কেন প্রতি বছর প্রায় একই সময়ে এই ফ্লু হয়, এর ধারাবাহিকতার কারণ কী বা কেন এখনও এর কোনো একক ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি, যা ভবিষ্যতে সব ধরনের ফ্লুর প্রাদুর্ভাব থেকে আমাদের রক্ষা করে? এমন প্রশ্নও উঠছে।
এর জবাব হল– ফ্লু ভাইরাস ক্রমশ অভিযোজিত হয়ে চলেছে।
ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা তৈরি হয় ভাইরাস থেকে, যার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। তবে, এর জিনোমে থাকা ‘মিউটেশন ইনফ্লুয়েঞ্জা’ ভাইরাস মানুষকে সংক্রামিত করে ভাইরাসটিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
এ পরিবর্তনে ভাইরাসটি প্রাণী থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে এবং এটি নিয়মিতই ঘটে। আর এর ফলই হচ্ছে মৌসুমী ফ্লু।
যখনই ভাইরাসের এই ধরনের অনুপ্রবেশ ঘটবে, তখন মিউটেশন প্রক্রিয়ার কারণে ভাইরাসে সামান্য পরিবর্তন ঘটে। এতে করে আগের বছরের জন্য তৈরি ওষুধ পরের বছরের ফ্লু’র ভাইরাসের ওপর কাজ করে না। যে কারণে এই রোগের ভ্যাকসিন তৈরি এতটা জটিল।
এই একই কারণে এইচআইভি বা এইডস ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিও জটিল বিষয়। আর এই বিবর্তনের মূল উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে ভাইরাস, যা ক্রমাগত বিবর্তিত হচ্ছে।
এর পরও, এই বিবর্তন সম্পর্কে জানার কারণে মহামারী বিশেষজ্ঞদের কাজ খানিকটা সহজ হয়েছে। এমনকি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এমন ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির সম্ভাবনাও বেড়ে গেছে এতে।
একইভাবে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার মতো সমস্যা সমাধানে অগ্রগতি দেখিয়েছে এই বিবর্তনীয় ওষুধের ক্ষেত্র।
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসা হিসেবে মানুষকে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক নিতে দেখা যায়, যেখানে মানবদেহের বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া জিন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে বেঁচে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো পুনরায় বংশবৃদ্ধি করবে ও এদের বিভিন্ন জিন পরবর্তী প্রজন্মের ব্যাকটেরিয়াকে আরও ক্ষমতাবান করে তুলবে। আর এভাবে মানবদেহের মধ্যেই একটি বিবর্তন প্রক্রিয়া চলমান আছে।
এই একই কারণেই তথাকথিত ‘সুপারবাগ’-এমআরএসএ, ‘স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস’-এর মতো ব্যাকটেরিয়াকে অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে ধ্বংস করা যায় না, যা সাম্প্রতিক সময়ে একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠেছে।
কম্পিউটার প্রোগ্রামেও সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট
ডারউইনের তত্ত্ব থেকে ধারণা মেলে, কীভাবে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির বংশবৃদ্ধি হতে পারে। তবে ধারণাটি এমন সব ক্ষেত্রেও কাজ করে যেখানে প্রাণের অস্তিত্বই নেই– যেমন কম্পিউটার প্রোগ্রাম!
এর মৌলিক ধারণা হল– বিভিন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রামে এলোমেলোভাবে ছোট ছোট পরিবর্তন আসে। ঠিক যেভাবে কোনো জীবের বিভিন্ন মিউটেশন জীবিত প্রজাতির ডিএনএ’র পরিবর্তন ঘটায়।
প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মতোই, বিভিন্ন সংস্করণের প্রোগ্রাম কম্পিউটার মেমরিতে প্রবেশের জন্য প্রতিযোগিতা করে, যেখানে বিভিন্ন কার্যকর প্রোগ্রামের অনুলিপি বানিয়ে আরও দক্ষ প্রোগ্রাম তৈরি হয়।
এই ধরনের ‘ডিজিটাল বিবর্তন’ পন্থা বিভিন্ন জটিল প্রযুক্তিগত সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ হিসেবে, নাসা কর্মীদের মহাকাশযানের জন্য যে ধরনের অ্যান্টেনা প্রয়োজন, তা এখনও কোনও মানব প্রকৌশলী নকশা করতে পারেননি। তবে ডিজিটাল বিবর্তন প্রযুক্তির সহায়তায় খুব দ্রুতই একটি কার্যকর ডিজাইন তৈরি করতে পেরেছে নাসা।
দুর্ভাগ্যবশত, বিবর্তন পদ্ধতিও খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। কম্পিউটারের ম্যালওয়্যার তৈরির ক্ষেত্রেও সমানভাবে কার্যকর এমন ডিজিটাল বিবর্তন ব্যবস্থা। ম্যালওয়ার এমন প্রোগ্রাম, যা কম্পিউটারের কার্যকারিতা ব্যাহত করার পাশাপাশি ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করতে সক্ষম।
কৃত্রিম বাছাই
ডারউইন ভালো করেই জানতেন যে, মানুষ নিজের স্বার্থেই বিবর্তনকে কাজে লাগাতে পারবে। তিনি ‘দ্য অরিজিন অফ স্পিশিজ’ শুরু করেছিলেন এমন কিছু উদাহরণ দিয়ে, যেখানে মানুষকে নিজের খাদ্য, শ্রম ও সঙ্গীর পরিসর বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের ফসল, পশুসম্পদ ও পোষা প্রাণীর বংশবিস্তারে প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
ডারউইন জানতেন, এইসব উদাহরণ সাধারণ মানুষের কাছেও পরিচিতি পাবে। আর এর চেয়েও দরকারী উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৃদ্ধির প্রক্রিয়া, যাকে তিনি ‘কৃত্রিম বাছাই’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, তা আদতে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মতোই কাজ করে।
তবে একুশ শতকে কৃত্রিম বাছাইয়ের মাধ্যমে বিবর্তনীয় পরিবর্তন দেখানোর ক্ষেত্রে মানুষের ক্ষমতা, ডারউইনের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
ডারউইনের ধারণা অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ হলেও তাতে একটি মৌলিক উপাদানের ঘাটতি ছিল। তিনি জানতেন, জীবন কীভাবে বিবর্তিত হয় তা সম্পূর্ণরূপে বোঝার ক্ষেত্রে প্রয়োজন বংশগতির প্রকৃতি জানা।
গোটা বিশ শতকজুড়ে জীবের জেনেটিক খাত আবির্ভূত হওয়ার পাশাপাশি এর উন্নতিও ঘটেছে। বিশেষ করে ১৯০০ সালে মটর গাছের উপর গ্রেগর মেন্ডেলের পরীক্ষা থেকে শুরু করে ৫০’র দশকে ডিএনএ’র কাঠামো ব্যাখ্যা, ২০০০ সালে মানব জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের ঘোষণা আসা পর্যন্ত ক্রমশ সবার নজরে এসেছে ডারউইনের তত্ত্বের অনুপস্থিতি।
জেনেটিক্স ও বিবর্তনকে সমন্বিত করা কেবল জীববিজ্ঞানীদেরকে কীভাবে বিবর্তনের ফলে আজ জীবিত প্রজাতির জন্ম দেয় তার ইতিহাসকে একসঙ্গে করতে সাহায্য করেনি, বরং এটি প্রজাতির ভবিষ্যত বিবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণী ও নিয়ন্ত্রণ করার নতুন উপায়েরও জন্ম দিয়েছে।
বর্তমানে নতুন টুল’সহ জিন সম্পাদনার প্রক্রিয়াটি ‘সিআরআইএসপিআর’ নামে পরিচিত, যা সুনির্দিষ্ট ও নিজস্ব উপায়ে বিভিন্ন প্রজাতির বিবর্তন নিয়ে সম্ভাবনার জানান দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রযুক্তি যথেষ্ট উন্নত হলেও মানুষের ব্যবহার করার আগে অবশ্যই এই পদ্ধতির নিরাপদ ও নৈতিকতা নিশ্চিত করারও প্রয়োজনীয়তা আছে।
তবে ডারউইনের তত্ত্ব একুশ শতকের জীবনে প্রয়োগ করা হলে তা কেমন হতে পারে, এমন অনেক কিছুই তার কল্পনায় আসেনি।
তবে তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে, তখন তার এ ধারণাটি সবে শুরু হচ্ছে। ‘দ্য অরিজিন অফ স্পিশিজ’-এর শেষ অনুচ্ছেদে ডারউইন লিখেছেন, “ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ক্ষেত্রে আমি আরও সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।”