Home শিক্ষা-ক্যাম্পাস তোমার সঙ্গে এটা-ওটা করলে কেমন হতো? ঢাবি শিক্ষক
ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪

তোমার সঙ্গে এটা-ওটা করলে কেমন হতো? ঢাবি শিক্ষক

‘আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে পারে। ভাবতে তো দোষের কিছু নাই। ধরে নাও, আমাদের বিয়ে হলে কেমন হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেমন হবে? তোমার সঙ্গে এটা-ওটা করলে কেমন হতো? মনে করো, আমরা সি-বিচ গেছি, সান-বাথ।’

এই বার্তাগুলো কোনো প্রেমিক-প্রেমিকার নয়, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ তার এক নারী শিক্ষার্থীকে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

শুধু এই কয়েকটি বাক্যই নয়, বিভিন্ন সময়েই তাকে এমন আরও নানা ধরনের যৌন উত্তেজনামূলক কথাবার্তা বলতেন, আমন্ত্রণ জানাতেন নিজ বাসায়ও, অভিযোগ ভুক্তভোগীর।

এ ঘটনায় শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর বরাবর অধ্যাপক নাদির জুনাইদ কর্তৃক এমন যৌন হয়রানি ও মানসিক নিপীড়নের বিচারের দাবিতে একটি অভিযোগপত্র প্রদান করেছেন। এর একটি অনুলিপি রবিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ বরাবর প্রেরণ করা হবে বলে ভুক্তভোগীসূত্রে জানা গেছে।

যৌন হয়রানির অভিযোগে ঢাবি শিক্ষক সাময়িক বরখাস্ত
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, ২০২২ সালে করোনার পর এক কোর্সে ওনাকে নাদির জুনাইদ স্যারকে আমরা প্রথম সশরীরে ক্লাসে পাই। প্রতি ক্লাসেই তিনি অ্যাসাইনমেন্টের টপিক নির্ধারণ করতে বলতেন এবং টপিক অনুমোদনের জন্য ওনাকে সরাসরি ফোন দিতে বলতেন। এ সুবাদে আমি টপিক নির্ধারণের জন্য তাকে চারবার ফোন দিই, কেননা তিনি বারবার টপিক বাতিল করছিলেন। প্রতিবার ফোন দিলে তিনি রাতে কল ব্যাক করতেন এবং ন্যূনতম এক ঘণ্টা ধরে কথা বলেছেন। এসময় তিনি টপিকের বাইরে গিয়েও ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগ্রহ সহকারে কথা বলেছেন।

একই বছরের ২৫ অক্টোবর তিনি আমার ফেসবুক ইনবক্সে ওনার একাউন্ট থেকে মেসেজ করেন, ‘ছোট চুলে কেমন লাগছে?’ কোন ধরনের ভূমিকা ছাড়া এমন প্রশ্নে অবাক হলেও নিজেকে সামলিয়ে উত্তর দিই। সেদিন খুব সাধারণ কথোপকথন হয়। ২০২২ সালে ওনার কোর্স শেষ হয়। এর মধ্যে উনি একদিন আমাকে ফেসবুকে নক দিয়েছিলেন, কিন্তু ফেসবুকে না থাকায় রেসপন্স করতে পারিনি। পরে ওনার মেসেজ দেখে আমি ওনাকে কল দিই। সেদিন ওনার সঙ্গে পরীক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে কথা হয়।

একপর্যায়ে উনি আমার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে জানতে চান, আমার কারও সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে কি না এ নিয়ে জানতে চান। উনি সবসময় জিজ্ঞেস করতেন ওনাকে আমার কেমন লাগে ইত্যাদি। একপর্যায়ে, তিনি তার বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলেন এবং স্পষ্টভাবে আমার দিকে ইঙ্গিত করেন। আমি খুব অবাক হই এবং খুব অস্বস্তিতে পড়ি। তবে, আমি কৌশলে তাকে নাকচ করে দিই। আমার বক্তব্যে শব্দ বা বাক্যের তারতম্য থাকতে পারে, কিন্তু আমার সেই দিনের কথার অর্থ এটাই ছিল।

এরপর উনি আমাকে নিজে থেকে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে পারে।’ আমি সেই সময় হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়েছি। আবার বলেন, ‘আচ্ছা ভাবতে তো দোষের কিছু নাই। আমরা না হয় ভাবলাম! ধরে নাও না, আমাদের বিয়ে হলে কেমন হবে? ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেমন হবে?’ এই ধরনের কথাগুলো ছিল আমার জন্য প্রচণ্ড রকম বিব্রতকর এবং অপ্রীতিকর। কিন্তু শিক্ষক হওয়ায় ওনাকে না-ও করতে সাহস পাচ্ছিলাম না। যতটা না বলে পারা যাচ্ছিল না, ততটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছিলাম। আমি আগ্রহ দেখাচ্ছি না দেখে উনি প্রচণ্ড বিরক্ত হতেন। একপর্যায়ে (১৬ ডিসেম্বরে) উনি রাগ করে আমাকে হোয়াটসআপে ব্লক করে দেন।

ভুক্তভোগী আরও বলেন, ব্লক দেওয়ার একমাস পর উনি নিজে থেকেই আবার যোগাযোগ করে আমার খোঁজ নেন; মূলত কোনো একটা বইয়ের বিষয়ে উনি আমার কাছে একটা পাবলিকেশনের নাম জানতে চেয়েছিলেন, তারপর আমিও শিক্ষার্থী হিসেবেই ওনার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছিলাম। এইভাবেই ওনার সঙ্গে আবার একটা যোগাযোগ শুরু হলো, উনি ওনার লেখা পাঠাতেন বা বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতেন, ওনার বিভিন্ন ব্যক্তিগত অভিমত জানাতেন। এই পর্যন্ত সব সহ্যের মধ্যে ছিল, সীমার মধ্যে ছিল। এইভাবেই ২০২৩ সাল শুরু হয় কখনো দুইমাসে, কখনো একমাসে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ হতো। কিন্তু হঠাৎ উনি যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন। এসময় অন্তরঙ্গ বিষয় নিয়ে অনেক কথা বলতে চাইতেন। এসময় তিনি বিভাগের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ বিষয়ও আমাকে জানান।

তিনি আমার শারীরিক অবয়র সম্পর্কে নোংরা মন্তব্য করতেন এবং যৌন উত্তেজনা প্রকাশ করতেন। একই সঙ্গে আমাকে ওনার সঙ্গে বাজে জিনিস কল্পনা করতে প্ররোচিত করতেন। বলতেন, ‘ধরে নাও তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে, তোমার সঙ্গে এটা করলে ওটা করলে কেমন হতো’, ‘মনে করো, আমরা সি-বিচ গিয়েছি, সান- বার্থ…’। এ ছাড়াও বিভিন্ন ডাবল মিনিং কথাবার্তা বলতেন এবং সারাক্ষণ ‘সেক্সুয়াল’ কথোপকথনে প্ররোচিত করতেন। বিষয়টি সহ্যের সীমার বাইরে যেতে থাকল। উনি বিভাগের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে আমাকে নজরদারি করতেন। এ ছাড়াও অন্য শিক্ষার্থীদেরও নজরদারি করতেন এবং তাদের নিয়ে আমার কাছে বিভিন্ন মন্তব্য করতেন। আমাকে কোনো ছেলে সহপাঠীর সঙ্গে দেখলে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন এবং তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করতেন। উনি আমার সঙ্গে এমন কথাবার্তা বলতেন, এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন আমার প্রতি, যার বেশিরভাগ কথাই সাধারণত স্বামী স্ত্রীর মধ্যে হয়ে থাকে। এই ধরনের কথাগুলো ছিল আমার জন্যে তীব্র যন্ত্রণার।

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, আমি কত রাত ঘুমাতে পারিনি, কত দিন এই অস্বস্তি এবং মানসিক কষ্ট নিয়ে রাত দিন পার করেছি কেউ জানে না। ওনার বেশিরভাগ কথায় আমি হাসতাম বা হেসে উড়িয়ে দিতাম বা না বোঝার ভান করতাম। কারণ এ ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। ওনার ওই ধরনের অন্তরঙ্গ কথাবার্তা বা ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তার অনেক আমি বুঝেও ওনাকে বলতাম বুঝিনি, বিভিন্নভাবে এড়িয়ে গেছি। কিন্তু আমার নীরবতা বা আমার অট্টহাসিকে সম্মতি বা দুর্বলতা ভেবেছেন। এরপরও উনি এইসব কথা বলা থামাননি বরং সেটা বিভিন্ন আকার ইঙ্গিতে তা আরও বেড়েছে। উনি সাধারণত ১০-১১টার মধ্যে কল দিতেন। কিন্তু যৌন ইংগিতপূর্ণ কথা শুরু করলে গভীর রাত পর্যন্ত কথা বলতে চাইতেন। তিনি বিভিন্ন সময় আমাকে বিয়ের পর তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও আর্থিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিতের কথাও বলেছেন।

ওই শিক্ষকের বাসায় আমন্ত্রণের বিষয়ে ভুক্তভোগী বলেন, আমি ফ্রি থাকলেই ঘন ঘন দেখা করতে চাইতেন এবং তার বাসায় আমন্ত্রণ জানাতেন। আমি প্রতিবারই বিভিন্ন অযুহাতে নাকচ করতাম। বিষয়টি উনি বুঝতে পারলে বকাঝকা করতেন। পরে একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে দেখা করি। ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ওনার জন্মদিন উপলক্ষে আমাকে নভেম্বরেই দাওয়াত দেন। জন্মদিন কাছে আসলে উনি আমাকে বারংবার বাসায় যাওয়ার জন্য বলতে থাকেন। আমি বলি, আপনার পরিবার অবগত আছে কি না। উনি নিশ্চিত করলে জন্মদিনে তার বাসায় যাই। ওনার বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করি। একপর্যায়ে উনি ছাদে নিয়ে যান। এসময় সিঁড়ির কাছে তিনি আমার উচ্চতা পরিমাপের কথা বলে কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করেন। এক সময় আমার কাছে এসে বলেন, এটাকেই বলে ‘জিরো ফিট ডিসট্যান্স’। এসময় আমি প্রচণ্ড অসহায়বোধ করতে থাকি। আমি ফিরে আসার পর উনি আমাকে আবার ফোন দেন। বলেন, ‘(বাসায়) কী ইচ্ছা করছিল জান, তোমাকে হাগ করে, ইচ্ছেমতো যা করার’। আমি কোনোভাবে বিষয়টি এড়িয়ে যাই।

হতাশা প্রকাশ করে এই শিক্ষার্থী বলেন, অনিচ্ছাসত্ত্বেও কারও সঙ্গে কথা বলা, তার ওপর আবার যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলা বা শোনা কতটা টর্চার, কতটা কষ্টের, কতটা বেদনাদায়ক! আমি প্রায়ই অনাগ্রহ দেখাতাম, পাশ কাটিয়ে যেতাম, এটা উনিও বুঝতেন। কিন্তু তাতে উনি এসব কথা বলা বন্ধ করেননি, উনি আমার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন করতেন, দেখতে কেমন, ইত্যাদি নানা কথার প্রশ্ন উনি খুব আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করতেন। এড়িয়ে গেলেও আবার একই কথা রিপিট করতেন, আমাকে প্রায় জিজ্ঞেস করা হতো আমার কেন কোনো অনুভূতি হয় না? আমার শারীরিক কোনো চাহিদা কেন নাই? আমার ইচ্ছা করে কিনা? আমাকে এমনও বলেছেন, ‘আই অ্যাম সরি টু সে, তুমি স্বাভাবিক না, তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত।’ উনি বারবার আমাকে মানসিক চাপ দিতেন, কেন কোনো অনুভূতি নাই? কেন ওনাকে আমি ফিল করি না! উনি আমাকে এত বুঝাচ্ছেন, তবুও আমি সাড়া দিতাম না। উনি আমাকে এই বলে চিৎকার করে বলেন, ‘তুমি একটা নির্বোধ, অনুভূতিহীন গবেট।’ ২০২৩ সালে ম্যামের পরিবর্তে একটি কোর্সে ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। আমি কেন ওনার সঙ্গে যৌন উত্তেজনাকর কথায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছি না, সেই বিরক্তি ক্লাসেও প্রকাশ করতে থাকলেন।

ভুক্তভোগী আরও বলেন, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে দিনের পর দিন ওনার যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছি, কারণ ওনার কাছে অনেক ক্ষমতা এই ভেবে। আমি একজন সামান্য শিক্ষার্থী এই ভেবে। পাশাপাশি উনি আমাদের সামনের চেয়ারপারসন। শুধু এই ভয়ে আমার পরিবারের কাছে আমার দেড় বছর আগে থেকে বলতে হচ্ছে যে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করব না। দরকার হলে নিজের টিউশনির টাকা দিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করব! কারণ আমি অনেক কাছ থেকে দেখেছি একজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত আক্রোশ কত ভয়ংকর হতে পারে। যেই ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হতে পারি বলে আমি গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে নিজের ওপর হওয়া যৌন হয়রানি মুখ বুজে সহ্য করেছি। আমি বিগত দেড় বছর প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু এ যন্ত্রণার প্রকাশ আমি ওনার সামনে করতে পারিনি। একপর্যায়ে এ যন্ত্রণার পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায়, আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না। গত বছরের শুরুতে আমি কাউন্সিলিং-ও করি। ঘুমানোর জন্য ঘুমের ওষুধ খেতে হতো।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, আমি সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীর অভিযোগপত্র পেয়েছি। ওই শিক্ষার্থী এটা উপাচার্য মহোদয়কেও হয়তো দিবে। উনি (উপাচার্য) আজ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আছেন। আগামীকাল সকালে তা হাতে পেলে সিদ্ধান্ত নিবেন হয়তো।

এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদকে মুঠোফোনে কল দিয়ে পাওয়া যায়নি।

এর আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে ফলাফলে ধস নামিয়ে দেওয়া ও ফল প্রকাশের আগেই শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেওয়াসহ নানা অভিযোগে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে উপাচার্য বরাবর একটি অভিযোগপত্র দেন ওই বিভাগের স্নাতকোত্তরের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। এর রেশ কাটতে না কাটতেই এই নারী শিক্ষার্থী এমন অভিযোগ তুললেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *