লাগামহীন দ্রব্যমূল্য এবং একজন চিন্তিত ভোক্তার কিছু অজানা প্রশ্ন ও চিন্তার ফল।
তাইফুর রহমান, সমাজকর্মী এবং লেখক।
লাগামহীন দ্রব্যমূল্য এবং একজন চিন্তিত ভোক্তার কিছু প্রশ্ন ও চিন্তার ফল।নতুন মন্ত্রী কি পারবেন মধ্যবিত্তদের কপালের ভাজ মুছে দিতে?
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে আমরা যতই বলি না কেন? আসলেই কি এই দেশে বিপ্লবী হওয়া সম্ভব? যখন এদেশের প্রতিটা সিস্টেমের কোনায় কোনায় ভূত।এই অজানা শক্তিধর সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ কি আদৌ সম্ভব?
আমরা দেখেছি যখনই কেউ কোনো ভালো কাজ শুরু করেছেন তখনই হয় তাকে থামিয়ে দেয়া হয়েছে অথবা মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে অথবা তাকে কোনোভাবে হত্যা করা হয়েছে।
ধরেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা সবখানে আলোচনা হচ্ছে। এখানে আসলে দামটা বাড়ছে কিভাবে এটা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? কেউ কি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে? অথবা এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও কেউ অথবা কোন বিশদ গবেষণা হয়েছে কি?
দেশের সরকারি এত গোয়েন্দা সংস্থা থাকার পরেও কেন আমরা আসলে এই সমস্যাগুলো সঠিক সমাধান বের করতে পারি না? কেন আসলে মূল সমস্যাটাই খুঁজে বের করতে পারি না? আসলে কেন এই দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি বা লাগামহীন হয়ে গেল? তাহলে কি গোয়েন্দা সংস্থা এগুলো নিয়ে আসলে কোন কাজই করছে না? গোয়েন্দা সংস্থা কি আমরাই এই কাজে লাগাইনি বলে অন্য কোন কাজ নিয়েই ব্যস্ত আছে?
রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য প্রথমেই রয়েছে। সেই খাদ্যের বাজার লাগামহীন হয়ে যাওয়ার পরে প্রায়ই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরাও মাঝে মাঝে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। তখন আসলে প্রশ্ন জাগা কি স্বাভাবিক নয় আসলে এর নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?
আমরা সব সময় শুধু সিন্ডিকেট সিন্ডিকেট বলে বেড়াচ্ছি, কিন্তু আসলেই সিন্ডিকেট জিনিসটা কি? কারাইবা সিন্ডিকেট তৈরি করছেন? কেনই বা সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না? কিভাবে সিন্ডিকেটের হাতই বা এত লম্বা হয়? অথবা তাদের এত বিশাল ক্ষমতার উৎসই বা কি?
আলুর ভরা মৌসুমেও এত অতিরিক্ত দাম,ডিমের বাড়তি দাম,সুযোগ পেলেই কাচা মরিচ,জিরা পর্যন্ত লাগামহীন হয়ে যায়।গরুর গোস্ত সাধারন মানুষের নাগালের বাইরে।মূল্য বৃদ্ধি হয়েছিলো করোনাকালীন সময়ে,এরপরে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের সময়।তাই বলে এগুলো কি সব রাশিয়া থেকে অথবা ইউক্রেন থেকে আসে? সবজি, আলু, তেলাপিয়া মাছ, পাঙ্গাস মাছ,ডিম, এসব লাগামহীন হয় আবার আমদানির কথা শুনলেই নেমে যায়।যেমন ধরুন যখন ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি হল তখন তার ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে প্রতি কেজি পণ্যে থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়ে দিল। অথচ মূলত একটি পন্যবাহী ট্রাকে কমপক্ষে ১৩০০০-২০০০০ কেজি পণ্য পরিবহন করতে পারে। যদি একটি ট্রাকের ভাড়া ২০ হাজার টাকা ও হয় সে ক্ষেত্রে প্রতি কেজিতে মাত্র এক টাকা যুক্ত হতে পারে। তখন ডিজেলের কারণে ভাড়া বেড়েছিল হয়তো ২০০০০ টাকায় ৫০০০ টাকা, সেই পাঁচ হাজার টাকাকে আপনি যদি ২০ হাজার দিয়ে ভাগ করেন তাহলে প্রতি কেজিতে ৪০ পয়সার বেশি হবার কথা নয়। কিন্তু তখন প্রতি কেজি চিনি, প্রতি কেজি চাল ডালে ভাড়া পেরেছিল দুই থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত। তার মানে শুধু ডিজেলের নাম দিয়েই ১ লক্ষ টাকার বেশি করে নিয়েছেন। যদি একটি পণ্য তিনবার পরিবহন করতে হয় তাহলে সেখানে ভাড়া বাড়ার কথা এক টাকা বিষ পয়সা অথচ মূল্যবৃদ্ধি করেছিলেন চার থেকে পাঁচ টাকা । এখানে আসলে অতিরিক্ত মুনাফাই পণ্যগুলোকে নাগালের বাইরে নিয়ে গেছে কি?এবং আরেকটি বড় সমস্যা ছিল মধ্যস্থতার এই মধ্য সত্যভোগীরা। তারা উৎপাদক তথা উৎপাদনকারী এবং ভোক্তার মাঝখানে একটি বিশাল অংক মুনাফা করে নিয়েছেন যৌক্তিক কোন বিনিয়োগ ছাড়াই।এরপরে পণ্য পরিবহনের খরচের মধ্যে একটি বিশাল পরিমাণ অর্থ চলে যায় চাঁদাবাজদের হাতে। আমরা বিভিন্ন সময় সংবাদপত্রে দেখে থাকি একটি ট্রাক প্রথমেই ভাড়া খুজে পেতে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির নামে প্রথমে একপক্ষকে অর্থ প্রদান করেন। এরপরে পণ্য তোলার পরে যখন সেই পণ্যবাহী ট্রাক রওনা দেয় এরপরে পথে পথে বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক কল্যাণের নামে, নামে বেনামে রশিদ তৈরি করে চাঁদা তোলা হয়। বিশেষ করে এটিএন নিউজে আমরা অনেক সময় দেখেছি ঢাকার বিভিন্ন সড়কে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় চাঁদাবাজি করা হয়, তাদেরকে বিভিন্ন নামে রশিদ প্রদান করা হয় এটিকে বৈধ প্রমাণ করার জন্য । এই চাঁদাবাজি আজকেই নতুন নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছে। হয়তো সেটি দুই তিন দশক পর্যন্ত, এর মধ্যে কেউ এই চাঁদাবাজিকে বন্ধ করতে পারেনি। এই চাঁদার কারণে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই অতিরিক্ত খরচ সর্বশেষ উঠেছে ভোক্তার কাঁধেই।তাই আসলে এই পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য কিছুটা হলেও প্রশমিত করা যায়, অর্থাৎ পণ্যের মূল্য কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব যদি তা সঠিকভাবে সঠিক সংস্থার মাধ্যমে নিজ সদিচ্ছায় করা হয়।প্রতিটি পণ্য বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনকারীর উৎপাদন খরচের সাথে মিল রেখেই তার খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। আমাদের দেশে যেই প্রক্রিয়ায় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা হয় তা সব সময় বাজারের চাহিদা এবং যোগানের সাথে তাল মিলিয়ে করা হয়। যার ফলে অনেকাংশেই দেখা যায় কৃষক লোকসানের মুখে পড়ে গেছেন এবং মধ্যস্বত্বভোগী অতিরিক্ত মুনাফ অর্জন করেছেন।তাই হওয়া উচিত কৃষিজাত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা উচিত কৃষকের এজন্য থাকা উচিত কৃষকদের একটি প্রতিনিধি দল যা কার্যত প্রকৃতপক্ষে কাজ করবে এবং তারা প্রকৃতপক্ষেই কৃষক হবেন। কমাতে হবে ভোগের সংখ্যা উৎপাদনকারীর থেকে খুব সহজে পৌঁছে দিতে হবে ভোক্তার হাতে এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং প্রতিষ্ঠানগুলিকে। বাজারের নিয়ন্ত্রণ মহাজনদের থেকে হাত থেকে সরে তখনই জনপ্রতিনিধিদের হাতে যেতে পারে যার তত্ত্বাবধানে থাকতে পারে স্ব স্ব ও উপজেলা প্রশাসন। একটি উপজেলা পর্যায়ে একটি উপজেলার বাজারে যেই পরিমাণ কাঁচামালের চাহিদা থাকে, বিশেষ করে সবজি এবং স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি উৎপাদনের স্থান থেকে ভোক্তার জন্য উপজেলার পর্যায়ে সরবরাহ করা যেতে পারে।এতে করে কম পক্ষে দুইজন থেকে তিনজন মধ্যসত্ব ভোগীর সংখ্যা কমে যাবে এবং সেই দুইজনের মুনাফা টাকা ওই পণ্যের উপর থেকে কমে যাবে। এভাবেই পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।এছাড়াও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের উপরে বিশদ গবেষণা হতে পারে।আমাদের দেশে অসংখ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেখানে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। কৃষকের সন্তানরা রয়েছেন,সরাসরি কৃষিতে সম্পৃক্ত লোকেরাও রয়েছেন। তাই অবশ্যই সেখান থেকে কার্যকরী কোন পরামর্শ বের হয় আশা সম্ভব । গবেষণার পরে অবশ্যই অসংখ্য উপায় বের হবে যেভাবে অতিরিক্ত দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এজন্য মূলত প্রয়োজন আমাদের সদিচ্ছা এবং সরকারি সহযোগিতা।