ধর্মব্যবসা নিষিদ্ধ এটা মানতে চায় না ধর্মব্যবসায়ী আলেম সমাজ
সম্পাদক, ভয়েস অফ বাংলাদেশ
ধর্ম এসেছে মানুষের সমাজে ন্যায়-শান্তি-সুবিচার উপহার দেওয়ার জন্য। সেই ধর্ম যখন কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ারে বা জীবিকার মাধ্যমে পরিণত হয় তখন সেই ধর্ম বিকৃত হয়ে যায়। সেটা আর ন্যায়-শান্তি-সুবিচার উপহার দিতে পারে না। অগণিত নবী-রাসুল পাঠানোটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। এ কারণে আল্লাহর একটি অপরিবর্তনীয় নীতি হচ্ছে, ধর্মকে ব্যবহার করে পার্থিব স্বার্থ হাসিল (ধর্মব্যবসা) নিষিদ্ধ। উল্লেখ্য যারা এই হারাম কার্যের সাথে জড়িত তারা স্বভাবতই নিজেদের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার ভয়ে এ দলিলগুলো মানুষের কাছে গোপন রাখেন।
আল্লাহর বিধান গোপন করা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্যতম অপরাধ। কুফর শব্দের অর্থ হচ্ছে সত্য ঢেকে রাখা। সত্য মানুষকে শান্তির পথ, জান্নাতের পথ দেখায়। যারা সে সত্যকে গোপন করে তারা পৃথিবীতে মানুষের শান্তি লাভের অন্তরায় এবং পরকালে জান্নাত লাভের অন্তরায়। এ ঘৃণ্য কাজ যারা করবে তারা যে পৃথিবীতেই জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করছে, তারা যে পথভ্রষ্ট তা আল্লাহ সুরা বাকারার ১৭৪-১৭৫ নম্বর আয়াতে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেছেন,
“বস্তুত, যারা আল্লাহ কিতাবে যা অবতীর্ণ করেছেন তা গোপন করে এবং এর বিনিময়ে পার্থিব তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ঢুকায় না। এবং আল্লাহ হাশরের দিন তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না। এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব। এরাই হচ্ছে সেই সমস্ত মানুষ যারা সঠিক পথের (হেদায়াহ) পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা (দালালাহ) এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করে নিয়েছে। আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল।
আরেকটু স্পষ্ট করে বুঝে নেই-
(১) তাদের সকল নেক আমল অর্থহীন।
(২) হাশরের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না
(৩) তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না।
(৪) তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব।
(৫) তারা হেদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে।
আমরা আলেম সমাজের কাছে কেন যাই, কেন তাদের ওয়াজ, খোতবা নসিহত শ্রবণ করি? নিশ্চয়ই পরকালীন মুক্তির পথ জানার জন্য, হেদায়াতের জন্য? অথচ যে সকল আলেমগণ ধর্মের কাজের বিনিময়ে অর্থ/স্বার্থ গ্রহণ করে তারা নিজেরাই পথচ্যুত। একজন পথচ্যুত মানুষ কী করে অপরকে পথ দেখাবে?
এ কারণেই সুরা ইয়াসিনের ২১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “তাদের অনুসরণ করো যারা তোমাদের কাছে কোনো প্রকার বিনিময় চায় না এবং যারা সঠিক পথে, হেদায়াতে আছে।” এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যদি কোনো ব্যক্তি বিনিময় গ্রহণকারীর, বিনিময় কামনাকারীর পেছনে উপাসনায় অংশ নেয় তাহলে সে আল্লাহরই নাফরমানি করল।
আল্লাহর দৃষ্টিতে দ্বীন ব্যবসা কত ঘৃণিত তা উপলব্ধি করার জন্য সুরা বাকারার ১৭৪ নম্বর আয়াতের পূর্বের আয়াতটিও পড়া দরকার। সুরা বাকারা ১৭৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন “তিনি তো হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শুকরের মাংস এবং যা আল্লাহ ব্যতিত অন্য উপাস্যের প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি অনন্যোপায় হয়ে, লোভের বশবর্তী না হয়ে বা সীমালঙ্ঘন না করে তা ভক্ষণ করে তাহলে তার কোনো গোনাহ হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময় (সুরা বাকারা ১৭৩)।
লক্ষ্য করুন, এ আয়াতে আল্লাহ কয়েকটি বস্তু ভক্ষণকে হারাম করলেন, কিন্তু কেউ যদি বাধ্য হয়ে খায় তাহলে তাকে তিনি ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী আয়াতে যেখানে আল্লাহ দীনের বিনিময়ে অর্থগ্রহণ করাকে ‘আগুন খাওয়া’ বললেন, তার পরে কিন্তু এটা বললেন না যে, অনন্যোপায় হয়ে কেউ খেলে আল্লাহ সে অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। এতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, কোনো অবস্থাতেই, এমন কি জীবন গেলেও আল্লাহর দীনের কাজের পার্থিব বিনিময় গ্রহণ করা যাবে না। কেন এই কঠোর নিষেধাজ্ঞা তা পরের আয়াতে (২:১৭৬) ফুটে উঠেছে। আল্লাহ বলেন, “যে কারণে এ শাস্তি তা হলো, আল্লাহ সত্যসহ কিতাব নাজিল করেছেন। এবং যারা এই কেতাবের বিষয়বস্তু নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি করে তারা চূড়ান্ত পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।”
মনে রাখতে হবে, আল্লাহর দীন বিকৃত হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে মতভেদ সৃষ্টি। এ কাজটি সাধারণ মুসলিমরা করেন না, করেন কথিত ধর্মজ্ঞানীরা। তাদের দীন সংক্রান্ত মতভেদের পরিণামে জাতি আজ হাজারো ফেরকা-মাজহাবে-তরিকায় খন্ড বিখন্ড হয়ে গেছে। তারাবির সালাত ৮ রাকাত না ২০ রাকাত, নবী নূরের তৈরি, না মাটির তৈরি এসব অনর্থক বিষয় নিয়ে তারা শত শত বই লিখছেন, হাজার বছর ধরে বিতর্ক করে যাচ্ছেন। অথচ গোটা মুসলিম জাতি এখন পাশ্চাত্য বস্তুবাদী ধর্মহীন সভ্যতা দাজ্জালের গোলাম। তাদের এই দুর্দশাময় পরিস্থিতির জন্য দায়ী জাতির কথিত আলেম সাহেবরা, ফেরকা সৃষ্টিকারী ইমামগণ, দ্বীনের অতি বিশ্লেষণকারী মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুজতাহিদ, মুফতিগণ, ভারসাম্যহীন সুফিবাদী পীর, মাশায়েখ, বুজুর্গানে দীনেরা। তারা তাদের অনুসারী তৈরি করেছেন, রাসুল (সা.) এর হাতে গড়া জাতি ছিন্নভিন্ন হয়ে প্রাণহীন লাশে পরিণত হয়েছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলামের প্রতিটি আমলের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। অন্য কোনো উদ্দেশে আমল করা হলে সেটা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না, সেটার বিনিময়ও আল্লাহর কাছে পাওয়া যাবে না। কেয়ামতের দিন এমন একজন ‘আলেমকে’ উপস্থিত করা হবে যে দীনের জ্ঞান অর্জন করেছে এবং মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছে এবং কোর’আন পাঠ করেছে। অতঃপর তাকে আল্লাহর নেয়ামতসমূহ স্মরণ করানো হবে। সেও তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, “আমার দেয়া নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ?”
সে বলবে, “আমি আপনার দেওয়া নেয়ামতের বিনিময়ে দীনের জ্ঞান অর্জন করেছি, অন্যকে তা শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্যে কোর’আন পাঠ করেছি।”
আল্লাহ বলবেন, “তুমি মিথ্যা বলছো; বরং তুমি এই জন্যে বিদ্যা শিক্ষা করেছিলে যাতে করে মানুষ তোমাকে আলেম বলে। আর এই জন্যে কোর’আন পাঠ করেছিলে যাতে লোকেরা তোমাকে ক্বারী বলা হয়। পৃথিবীতে তোমাকে এই সব বলা হয়ে গেছে।” এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের আদেশ দেয়া হবে। অতঃপর নাক ও মুখের উপর উপুড় করে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিমঃ কিতাবুল ইমারাহ)
যারা কোর’আন পাঠের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সঃ কঠোর ভাষায় হুশিয়ারি করেছেন। আবদুর রহমান ইবনে শিবল রা. বলেন, আমি রাসুলাল্লাহকে বলতে শুনেছি যে, “তোমরা কোর’আন পড় তবে তাতে বাড়াবাড়ি করো না এবং তার প্রতি বিরূপ হয়ো না। কোর’আনের বিনিময় ভক্ষণ করো না এবং এর দ্বারা সম্পদ কামনা করো না।’ -মুসনাদে আহমদ ৩/৪২৮; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৫/২৪০; কিতাবুত তারাবীহ।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদিসে পাওয়া যায়, রাসুলাল্লাহ (সা.) সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা সৌভাগ্য দ্বারা পরিবেষ্টিত রয়েছো। তোমরা আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে থাকো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসুল সঃ বর্তমান। অদূর ভবিষ্যতে এমন এক যামানা আসবে যখন তীরের ফলক যেরূপ সোজা করা হয় লোকেরা কোর’আন তেলাওয়াতকে সেভাবে সোজা করবে। তারা দ্রুত তেলাওয়াত করে নিজেদের পারিশ্রমিক আদায় করবে এবং এতে তাদের কোনো বিলম্ব সহ্য হবে না। (ভূমিকা, তাফসির ইবনে কাসীর)।
সুতরাং পবিত্র কোর’আন পাঠ করে বা দীন শিক্ষা দিয়ে ‘হাদিয়া’ গ্রহণ করতে আল্লাহর রাসুল সঃ সরাসরি নিষেধ করেছেন।
উবাদা ইবন সামিত (রা.) বলেন, “আমি আহলে-সুফফার কিছু লোককে লেখা এবং কোর’আন পড়া শেখাতাম। তখন তাদের একজন আমার জন্য একটি ধনুক হাদিয়া হিসেবে প্রেরণ করে। তখন আমি ধারণা করি যে, এ তো কোন মাল (সম্পদ) নয়, আমি এ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় তীরন্দাযী করবো।
এরপর রাসুলাল্লাহর (স.) নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি: ইয়া রসুলাল্লাহ (স.)! আমি যাদের কোর’আন পড়া এবং লিখা শিখাই, তাদের একজন আমাকে হাদিয়া হিসেবে একটি ধনুক প্রদান করেছেন, যা কোন সম্পদই নয়। আমি এ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় তীরন্দাযী করবো। তিনি (স.) বলেন: তুমি যদি তোমার গলায় জাহান্নামের কোন বেড়ি পড়াতে চাও তবে তুমি তা গ্রহণ করো।’ (আবু দাউদ, চতুর্থ খ-, হাদিস-৩৩৮১)।
ঘটনাটি অত্যন্ত শিক্ষণীয়। লক্ষ্য করুন, তিনি কিন্তু ধনুকটি চেয়ে নেন নি, আশাও করেন নি বরং সেটা হাদিয়া হিসাবে দেওয়া হয়েছিল। তিনি তা এ ভেবে গ্রহণ করেন যে এটা তো কোনো ব্যক্তিস্বার্থে (সম্পদ) ব্যবহার করবেন না, বরং দীন প্রতিষ্ঠার জেহাদে এটি ব্যবহার করবেন। তবু তাঁর অন্তরে একটি দ্বিধা থেকে গেল, কারণ তিনি জানতেন দীনের বিনিময় গ্রহণ হারাম। তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য রাসুলাল্লাহর (সা.) কাছে ঘটনাটি বললেন। উপহার হওয়া সত্ত্বেও, ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সেটা ব্যবহার করা হবে জেনেও রাসুলাল্লাহ সেটা গ্রহণ করতে দিলেন না।
প্রকৃতপক্ষে যে কোনো প্রকার ধর্মীয় কাজের বিনিময় গ্রহণ করতেই রাসুলাল্লাহ সঃ নিষেধ করে গেছেন। ওসমান বিন আস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস। তিনি বলেন, রাসুলাল্লাহ সঃ আমাকে আমার গোত্রের ইমাম (নেতা) নিযুক্ত করে বললেন, ‘তোমাকে তাদের ইমাম নিযুক্ত করা হলো। তুমি দুর্বল ব্যক্তিদের প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখবে এবং এমন এক ব্যক্তিকে মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করবে যে আযানের কোনোরূপ বিনিময় গ্রহণ করবে না। (নাসাঈ, তিরমিযী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ)
বিদায় হজ্বের দিন আল্লাহর রাসুল সঃ যখন বললেন, “আজ যারা এই সমাবেশে উপস্থিত নেই তাদের কাছে যারা উপস্থিত রয়েছ তারা আমার এই কথাগুলো পৌঁছে দেবে।” সত্য প্রচারের এই যে দায়বদ্ধতা উম্মাহর উপর তাদের নেতা, আল্লাহর শেষ রাসুল সঃ কর্তৃক অর্পিত হলো সেই দায়িত্ব কি উম্মাহ টাকার বিনিময়ে পালন করবে? আল্লাহর রাসুল সঃ যা কিছু করেছেন তা কি তিনি অর্থের বিনিময়ে করেছেন? নাউযুবিল্লাহ। তিনি নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর নির্দেশে অতিবাহিত করেছেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য, মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ তাঁকে এর বিনিময়ে কোনো মজুরি, সম্পদ, বিনিময় গ্রহণ না করার জন্য অন্তত ছয়টি আয়াতে নির্দেশ প্রদান করেছেন।
আল্লাহ বলেছেন,
(১) এবং তুমি তাদের নিকট কোনো মজুরি দাবি করো না। এই বাণী তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ মাত্র। (সুরা ইউসুফ ১০৪)
(২) বল! আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক চাই না। এবং যারা মিথ্যা দাবি করে আমি তাদের দলভুক্ত নই। (সুরা সা’দ ৮৬)
(৩) …বল! আমি এর (দীনের) বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে প্রেম-ভালোবাসা ও আত্মীয়তাজনিত সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার ব্যতীত অন্য কোনো মজুরি চাই না। (সুরা শুরা – ২৩)
(৪) (হে মোহাম্মদ!) তুমি কি তাদের নিকট কোনো মজুরি চাও? তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানই তো শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা। (সুরা মুমিনুন: ৭২)
(৫) তবে কি তুমি তাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাচ্ছো যা ওরা একটি দুর্বহ বোঝা মনে করে? (সুরা তুর: ৪০)
(৬) তাদেরকেই (নবীদেরকেই) আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের পথ অনুসরণ কর; বল! এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোনো মজুরি চাই না। (সুরা আনআম – ৯০)
সমসাময়িক ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নেওয়ার দরুন পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণও তাদের দ্বারা প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন। তারা রুজি রোজগার বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি সম্মান ও কর্তৃত্ব খোয়ানোর আশঙ্কায় নবী-রাসুলদের বিরুদ্ধে জনগণ ও শাসক শ্রেণিকে খেপিয়ে তুলেছেন এবং নবী রাসুলদের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ আরোপ করেছেন। ঈসা (আ.) কে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার চেষ্টা করেছিল এই ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী কারণ তিনি তাদের মুখোস জনগণের সামনে খুলে দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “ভন্ড আলেম ও ফরীশীরা, কী নিকৃষ্ট আপনারা! আপনারা মানুষের সামনে জান্নাতে প্রবেশের দরজা বন্ধ করে রাখেন। তাতে নিজেরাও ঢোকেন না আর যারা ঢুকতে চেষ্টা করছে তাদেরও ঢুকতে দেন না। একদিকে আপনারা লোকদের দেখাবার জন্য লম্বা লম্বা মোনাজাত করেন, অন্য দিকে বিধবাদের সম্পত্তি দখল করেন
সুত্রঃ (নিউ টেস্টামেন্ট: ম্যাথু ২৩)
প্রত্যেক নবী-রাসুল তাদের জাতির উদ্দেশ্যে একটি সাধারণ ঘোষণা দিয়েছেন যে, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় রয়েছে আল্লাহর কাছে। এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিনি যা তাদের সামনে উপস্থাপন করছেন তা নির্ভেজাল সত্য, হক্, এতে মিথ্যার কোনো লেশ নেই। মানুষ তখনই মিথ্যা বলে যখন তার কোনো স্বার্থ থাকে। বিনিময় গ্রহণ না করা তাঁদের সত্যময়তার বড় একটি নির্দেশক। এ বিষয়ে নবী রসুলদের বেশ কয়েকজনের ঘোষণা আল্লাহ দৃষ্টান্তস্বরূপ পবিত্র কোর’আনেও সন্নিবদ্ধ করেছেন।
(১) নূহের (আ.) এর ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! এর পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন সম্পদ চাই না। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট। (সুরা হুদ-২৯)
(২) নূহের (আ.) এর ঘোষণা: আমি এর বিনিময়ে তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার পারিশ্রমিক তো কেবল বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে। (সুরা শু’আরা ১০৯)
(৩) নূহের (আ.) এর ঘোষণা: যদি তোমরা আমার কথা না শোনো তাহলে জেনে রাখ, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই নি। আমার প্রতিদান কেবল আল্লাহর নিকট এবং আমাকে মুসলিম (সত্যের প্রতি সমর্পিত) হওয়ার জন্য আদেশ করা হয়েছে। (সুরা ইউনুস ৭২)
(৪) হুদের (আ.) ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! আমি এর পরিবর্তে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাই না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি তবুও বুদ্ধি (আকল) খাটাবে না? (সুরা হুদ-৫১)
(৫) হুদের (আ.) ঘোষণা: আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাচ্ছি না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি এই বিশ্বজাহানের স্রষ্টা। (সুরা শু’আরা ১২৭)
(৬) সালেহ (আ.) এর ঘোষণা: আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। (সুরা শু’আরা-১৪৫)
(৭) লুতের (আ.) ঘোষণা: এর জন্য আমি কোনো মজুরি চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। (সুরা শু’আরা-১৬৪)
(৮) শোয়েবের (আ.) ঘোষণা: আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো মূল্য চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। (সুরা শু’আরা-১৮০)
ধর্মের কোনো কাজ করে নবী ও রাসুলগন পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন না, সুতরাং তাঁদের অনুসারী উম্মতের জন্যও পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ নয়। তথাপি নবীদের বিদায়ের পরে জাতির মধ্যে অবধারিতভাবে জন্ম নিয়েছে দীনের প্রতি, ধারক বাহক, আলেম, পুরোহিত, যাজক নামধারী একটি অকর্মণ্য, কর্মবিমুখ, পরনির্ভরশীল শ্রেণি। তারা নিজেদেরকে নবী-রাসুলদের প্রতিনিধি, ওয়ারিশ বা স্থলাভিষিক্ত (ওরাসাতুল আম্বিয়া) বলে দাবি করতে থাকেন কিন্তু আম্বিয়ায়ে কেরামের আদর্শের বিপরীতে গিয়ে ধর্মব্যবসায় মত্ত হয়ে যান।
পূর্ববর্তী কিতাবধারী জাতিগুলোর সেই অপকর্মের ইতিহাস পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বারংবার উল্লেখ করেছেন যেন রসুলাল্লাহর উম্মাহর আলেমরা পূর্ববর্তী পথভ্রষ্ট ধর্মব্যসায়ী আলেমদের মত না হন।
আল্লাহ বনী ইসরাইলকে বলেছিলেন, “তোমরা কিতাবের প্রাথমিক অস্বীকারকারী হয়ো না আর তুচ্ছমূল্যে আমার আয়াত বিক্রি করো না। এবং আমার (আযাব) থেকে বাঁচ। তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে গোপন করো না। (সুরা বাকারা ৪১, ৪২)
কিন্তু আল্লাহর এ হুকুমকে তারা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল এবং ধর্মকেই তাদের উপার্জনের মাধ্যম, স্বার্থসিদ্ধির উপকরণে পরিণত করেছিল। এর পরিণামে তারা আল্লাহর অভিশাপের বস্তুতে পরিণত হয়েছিল এবং শত শত বছর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর দ্বারা নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে করুণার পাত্র হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিল। এটা হচ্ছে পার্থিব শাস্তি। তাদের পরকালীন শাস্তি তো জমাই রয়েছে। তাদের ধর্মব্যবসা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ যখন তাদের থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তোমরা নিশ্চয়ই এটা মানুষের মধ্যে প্রচার করবে এবং তা গোপন করবে না। কিন্তু তারা তা তাদের পেছনে নিক্ষেপ করল এবং খুব কম মূল্যে বিক্রয় করল, অতএব তারা যা কিনল তা নিকৃষ্টতর। (সুরা ইমরান ১৮৭)
তারা দীনের আইন-কানুন, আদেশ, নিষেধগুলির চুলচেরা বিচার, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে করতে সেগুলো বিকৃত করে ফেলে। সে ইতিহাসও আল্লাহ বর্ণনা করেছেন, “তাদের (নবী ও প্রকৃত মো’মেন) পরে আসলো অপদার্থ উত্তরাধিকারীগণ, তারা সালাহ বিকৃত ও নষ্ট করল ও লালসা পরবশ হলো। সুতরাং তারা অচিরেই তাদের কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে (সুরা মারইয়াম ৫৯)”।
আল্লাহর শেষ রাসুল সঃ কর্তৃক আনীত ইসলামও তেরশ’ বছর পূর্ব থেকে দীন বিকৃত হতে হতে কালের পরিক্রমায় আজ সম্পূর্ণ বিকৃত ও বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। যদিও কোর’আনের অক্ষরগুলো পরিবর্তিত হয় নি কিন্তু বাস্তবে যে ইসলামটি চর্চিত হচ্ছে সেটা আর আল্লাহ-রাসুলের সেই সহজ সরল ইসলাম নয়। এই অবস্থা যে হবে সেটাও রাসুলাল্লাহ সঃ ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। তিনি বলেছেন, এমন সময় আসবে যখন
১) ইসলাম শুধু নামে থাকবে
২) কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে
৩) মসজিদসমূহ জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে সঠিক পথনির্দেশ (হেদায়াহ) থাকবে না
৪) আসমানের নিচে নিকৃষ্টতম জীব হবে আমার উম্মাহর আলেম সমাজ
৫) তাদের সৃষ্ট ফেতনা তাদের দিকেই ধাবিত হবে (আলী রা. থেকে বায়হাকি, মেশকাত)।
এই উম্মাহর আলেমদেরকে ‘আসমানের নিচে নিকৃষ্ট জীব’ বলার কারণ তারা হবে ধর্মব্যবসায়ী আলেম এবং তারা স্বার্থ হাসিলের জন্য ফেতনা সৃষ্টি করবে। বাস্তবেও আমরা দেখছি, মানুষের ঈমানকে হাইজ্যাক করে কিভাবে মিথ্যা গুজব রটিয়ে, কারো বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এই ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি। আর আল্লাহ ইসলাম নাজিলই করেছেন ফেতনা নির্মূল করার জন্য এবং মো’মেনদেরকে হুকুম দিয়েছেন ফেতনা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে (সুরা বাকারা ১৯৩, সুরা আনফাল ৩৯)।
ধর্মব্যবসায়ীদের একটি অংশ পীর সেজে বলছে, আমাদেরকে টাকা দাও, আমি তোমাদের নাজাতের অসিলা হবো। এদের বিষয়ে আল্লাহর পূর্বেই সতর্কবাণী ঘোষণা যে, “হে মো’মেনগণ! অধিকাংশ আলেম ও সুফিবাদীরা মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে এবং মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে। তারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে। তাদেরকে কঠোর আযাবের ‘সুসংবাদ’ শুনিয়ে দিন। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা (সোনা ও রূপা) উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং সে সঞ্চিত সম্পদের স্বাদ আস্বাদন করো। (সুরা তওবা ৩৪-৩৫)।” অথচ এইসব আলেম আর ভারসাম্যহীন সুফিবাদীদের কথায় কোটি কোটি মুরিদান নিজেদের জমি-জমা বিক্রি করে দিচ্ছে তাদের পায়ে সর্বস্ব ঢেলে দেয়, পীরদেরকে ভোট দেয়, তাদের আহ্বানে সংখ্যাধিক্যের অহঙ্কারে মুরিদানরা আস্ফালন করে, সুযোগ পেলেই তান্ডব ঘটায়, দেশ অচল করে দেওয়ার চেষ্টা চালায়।
ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে পবিত্র কোর’আনে আরো বহু আয়াত আছে, কিন্তু সেগুলোকে ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি গোপন করে তাদের হারাম উপার্জন চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা ভুলেও তাদের ওয়াজে, খোতবায় এগুলো উল্লেখ করেন না। কেউ যদি তাদেরকে এই আয়াতগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন তারা হাজারো অপব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে এ অবৈধ বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। পূর্ববর্তী ধর্ম-সম্প্রদায়ের আলেমরাও এভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিত। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তার কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা আবৃত্তি করছে তা আদৌ কিতাব নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর তরফ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নয়। তারা বলে যে, এটি আল্লাহর কথা অথচ এসব আল্লাহর কথা নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যারোপ করে (সুরা ইমরান ৭৮)।
সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং তুচ্ছ মূল্য প্রাপ্তির জন্য বলে: এটা আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে। তাদের হাত যা রচনা করেছে, তার জন্য তারা শাস্তিপ্রাপ্ত হবে এবং তারা যা উপার্জন করেছে সেজন্যও তারা শাস্তি প্রাপ্ত হবে। (সুরা বাকারা ৭৯)।
আমাদের সমাজের ধর্মজীবীরাও ঠিক এমনভাবেই সুর করে ওয়াজ করেন যেন তারা আল্লাহ রাসুলের কথাই বলছেন। কিন্তু আদৌ তা নয়। তারা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী একটি ইসলামকে আল্লাহর নামে চালিয়ে দেন। তাদের কাজের ফলে দীন বিকৃত হয়ে যাওয়ায় মুসলিম জাতি বহু আগেই পথ হারিয়ে ফেলেছে। এখন তারা বিগত চৌদ্দ শত বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংকটে পড়েছে। তারা সর্বত্র মার খাচ্ছে, উদ্বাস্তু হচ্ছে, তাদের দেশ ধ্বংস হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ধর্মের নামে চলা সব অধর্মকে পরিহার করে সত্যের উপরে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর যতদিন ধর্মব্যবসা চালু থাকবে ততদিন সত্য উদ্ভাসিত হতে পারবে না। তাই ধর্ম থেকে ধর্মব্যবসাকে পৃথক করতে হবে। এজন্য ধর্মব্যবসার ব্যাপারে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে।