দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ইসলামী দৃষ্টিকোণ।
মোঃ বাইজিদ হোসেন।
কয়রা খুলনা প্রতিনিধি।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি বর্তমানে সাধারণ জনগণের প্রধান সমস্যা এবং ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষেত্রে একটি সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর বিষয়ও।
সরকারের বিভিন্ন কলা কৌশল অবলম্বনে কোন কাজে আসছে না। কোন সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি ক্রমানবতি হয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজার মূল্য যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা ইতিমধ্যেই হালাল রোজগারকারী সীমিত আয়ে চলা সাধারণ জনগণের আয় থেকেও অনেক অনেক উপরে উঠে গেছে।
এ প্রেক্ষাপটেই আজকের আলোচনায় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বিষয়টি উঠে এসেছে। এখন খতিয়ে দেখতে হবে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারে ইসলাম কি কি ব্যবস্থা নিয়েছে। এবং বিশ্বায়নের যুগেও সে বিষয়গুলি যথাযথ বাস্তবায়িত হলে কিভাবে এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হতে পারে।
সরকার যদি আন্তরিক হয় তবে সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন ব্যাপার নয় এমনিভাবে টিসিপি কার্যকার করার মাধ্যমে নিজে ব্যবসা করেও সরকার বাজার মূল্যে অবদান রাখতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে সরকারের দায়িত্ব হল মানুষকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় বিধি-বিধান শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। ইসলামের কল্যাণমূলক বিষয় নীতি সম্পর্কে মানুষকে অবগত করে তা পালনে অভ্যস্ত করে তোলা। এবং মূলত এর দ্বারাই সম্ভব অবৈধ পন্থায় সম্পদ আহরণ থেকে মুসলমানদের ফিরিয়ে রাখা।
পর্যালোচনার মাধ্যমে দেশের ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যেসব কারণ বেরিয়ে আসে, তা নিম্নরূপ :
ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বলে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে। সরকারও বিভিন্ন সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য এসব ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেছে।
শিল্প মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের ওপর মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। ব্যবসায়ী এবং উৎপাদকরা চাঁদাবাজদের প্রদত্ত চাঁদার ক্ষতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে পুষিয়ে নেন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ ভোক্তারা।
আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারেও পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বাভাবিকভাবেই এর মূল্য বেড়ে যায়।
শুল্ক বৃদ্ধির কারণেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকির ক্ষেত্রে সরকারের অমনোযোগিতা ও ব্যর্থতা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি বিরাট কারণ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সরকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে বিভিন্ন সময় দায়ী করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় খুব কমই। ফলে শুল্ক কমানো সত্ত্বেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দ্রব্যমূল্য কমে না।
বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে ইসলামের ব্যবসায়িক নীতিমালা বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
মজুদদারির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। ইসলাম অধিক মুনাফার লোভে মজুদদারি নিষিদ্ধ করেছে। মা’মার ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ফাজালা (রা) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, পাপাচারী ছাড়া অন্য কেউ মজুদদারি করে না।’ (তিরমিজি)
অন্য হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি ৪০ রাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুদ রাখে, আল্লাহর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকে না।
ইবনে মাজাহ শরিফে বর্ণিত একটি হাদিসে রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যদ্রব্য ৪০ দিন পর্যন্ত মজুদ করে রাখে, আল্লাহতায়ালা তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ)
মজুদদারের ঘৃণ্য মানসিকতার নিন্দা করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মজুদদার কতই না নিকৃষ্ট! দ্রব্যমূল্য হ্রাসের খবর তার কাছে খারাপ লাগে; আর মূল্যবৃদ্ধির খবরে সে আনন্দিত হয়।’
ফিকহে হানাফির সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হিদায়া’য় উল্লেখ রয়েছে, ‘মানুষ ও গবাদিপশুর খাদ্য মজুদ করা মাকরুহ, যদি তাতে শহরবাসীর ক্ষতি হয়। যদি শহরবাসীর ক্ষতি না হয়, তাহলে মাকরুহ নয়।
‘ফতোয়া-ই-আলমগিরি’তে উল্লেখ রয়েছে, ‘ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, ‘নগরবাসী বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সরকার মজুদদারকে বাধ্য করবে, যেন সে তার পণ্য সাধারণ মূল্যে বা যতটুকু বেশি মূল্যে মানুষ মেনে নেয়, সেই মূল্যে বিক্রি করতে।
অন্যত্র উল্লেখ রয়েছে, মজুদদার সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করা হলে সরকার তাকে তার এবং তার পরিবারের প্রয়োজনাতিরিক্ত খাদ্য বিক্রির আদেশ দেবে এবং মজুদ করতে নিষেধ করে দেবে। যদি সে বিরত না হয়, তাহলে উপদেশ দিতে হবে, সতর্ক করতে হবে। এরপরও যদি বিরত না হয়, তার বিরুদ্ধে আবার মজুদদারির অভিযোগ ওঠে, তাহলে তাকে বন্দি করবে।
আল-মুজারাআত’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, ফকিহরা এ ব্যাপারে একমত, প্রয়োজনে মজুদদারদের সম্মতি ছাড়াই বিচারক মজুদকৃত খাদ্য বিক্রি করতে পারবেন।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) স্বল্পমূল্যে কেনার জন্য বহিরাগত বিক্রেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করেছেন।