Home অপরাধ রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার ‘নিয়ন্ত্রক’ তাঁরা ৩ জন
অক্টোবর ২৯, ২০২৩

রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার ‘নিয়ন্ত্রক’ তাঁরা ৩ জন

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া নিয়ন্ত্রণ করছেন একাধিক খুনের মামলার আসামি তিন জনপ্রতিনিধি। তাঁরা হলেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ ওরফে আলমাছ, রূপগঞ্জ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শাহরিয়ার পান্না ওরফে ভিপি সোহেল এবং মুড়াপাড়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. তাওলাদ।

পুলিশ সূত্র জানায়, তোফায়েল আহমেদ ওরফে আলমাছ তিন বছরের ব্যবধানে একজন ছাত্রলীগ নেতা ও একজন যুবলীগ কর্মী খুনের মামলার আসামি হন। শাহরিয়ার পান্না ওরফে ভিপি সোহেল তিনটি খুনের মামলার আসামি। অপরদিকে মো. তাওলাদের নামে দুটি হত্যা, একটি ধর্ষণসহ তিনটি মামলা রয়েছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, এই তিন জনপ্রতিনিধি মুড়াপাড়ার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁদের পৃথক বাহিনী রয়েছে। স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, এঁদের কারণে তাঁরা কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেন না।

গত দুই মাসে মুড়াপাড়ার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ১১ নেতা এবং অন্তত ১৫ জন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তবে তাঁদের কেউ এই তিনজনের বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাননি। এমনকি খুনের শিকার দুটি ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে প্রথম আলো। তারাও এ নিয়ে মুখ খুলতে সাহস পায়নি।

পুলিশ জানায়, এলাকার আধিপত্য নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে তাওলাদ ও ভিপি সোহেলের বিরোধ ছিল। তবে তাওলাদ ও ভিপি সোহেল একসঙ্গে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতেন। ২০২১ সালে ইউপি নির্বাচনের আগে তোফায়েল আহমেদের দলে যোগ দেন তাওলাদ। তখন তাওলাদের সঙ্গে ভিপি সোহেলের বিরোধ তৈরি হয়। এখন ইউপি চেয়ারম্যান তোফায়েল ও তাওলাদ একটি গ্রুপ এবং ভিপি সোহেল অন্য একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানান, মুড়াপাড়ার মাছিমপুর এলাকায় মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন মো. তাওলাদ ও ভিপি সোহেল। মাদকের বিরোধিতা করতেন স্থানীয় যুবক নজরুল ইসলাম। এর জেরে ২০১১ সালের মে মাসে তাঁকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নজরুলের বাবা জালাল মিয়া বাদী হয়ে তাওলাদ, ভিপি সোহেল ও তাঁর লোকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। দীর্ঘদিন ধরে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য জালাল মিয়াকে চাপ দিতে থাকেন তাওলাদ ও ভিপি সোহেলের লোকজন। কিন্তু ২০১৫ সালের ১৫ মে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে খুন করা হয় জালাল মিয়াকে। তাঁকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

মাছিমপুরে গিয়ে জালালের পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকজন জানান, জালালের পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।

রূপগঞ্জ আওয়ামী লীগের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে নজরুল ইসলাম এবং পরে তাঁর বাবা জালাল মিয়াকে নির্মমভাবে খুনের ঘটনা রূপগঞ্জে ব্যাপক আলোচিত ছিল। তারপরও ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ভিপি সোহেল। তারপর এলাকায় তাঁর আধিপত্য আরও বেড়ে যায়।

এর দুই বছর পর মুড়াপাড়া ইউপি নির্বাচনের সময় তোফায়েল আহমেদের দলে যোগ দেন তাওলাদ। এর জেরেই ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর ভিপি সোহেলের লোকজন তাওলাদের শ্যালক আবদুর রশিদ মোল্লাকে খুন করেন। এখন এলাকায় তোফায়েল ও তাওলাদ গ্রুপ ও ভিপি সোহেল গ্রুপ আলাদাভাবে আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে।

ইউপি সদস্য মো. তাওলাদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক কারণে তাঁর বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা হয়েছিল। একটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় পুলিশ তাঁর নাম বাদ দিয়েছে। আর ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলাটিও মিথ্যা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করছে।

তবে ভিপি সোহেলের মুঠোফোনে একাধিকার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে, তিনি প্রকাশ্যে এলাকায় আসেন না।

ইউপি চেয়ারম্যান যেভাবে নিয়ন্ত্রক

স্থানীয় লোকজন জানান, তোফায়েল ২০০০ সালে রাসেল ভূইয়া হত্যা মামলার আসামি হয়ে আলোচনায় আসেন। তখন বিএনপির রাজনীতি করতেন। রাসেল খুনের পর তিনি দীর্ঘদিন এলাকায় ছিলেন না। ২০০৯ সালে এলাকায় ফিরে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ধীরে ধীরে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করেন। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

স্থানীয় লোকজন আরও জানান, ২০১৮ সালে খুন হন মুড়াপাড়া সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান মাহমুদ রুবেল। এ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। তবে ওই মামলায় তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছে পুলিশ। ২০২১ সালে যুবলীগের কর্মী সোলায়মান খুনের মামলায়ও তিনি প্রধান আসামি।

তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। দল গোছানোর ক্ষেত্রে তাঁর একটা নিয়ন্ত্রণ আছে। তবে কোনো অপরাধের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন। ছাত্রলীগ নেতা রুবেলকে তিনি চিনতেন না। আর যুবলীগ কর্মী সোলায়মান চাঁদা আদায় করতে গিয়ে গণপিটুনিতে মারা গেছেন।

তাওলাদের বিষয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, তাওলাদ এখন ইউপি সদস্য। পাশাপাশি ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। এখন তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের অভিযোগ

বিএনপির নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, তোফায়েল ও তাওলাদের ভয়ে এলাকায় তাঁরা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারেন না। কর্মসূচি পালন করতে গেলে নানাভাবে ভয় ও হয়রানি করা হয়। এমনকি মারধর এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন বিএনপির ছয়জন নেতা।

নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ ও তাওলাদের ভয়ে মুড়াপাড়ায় কেউ কথা বলতে পারেন না। আর বিএনপির নেতা-কর্মীদের দিনের পর দিন হয়রানি ও নির্যাতন করছেন তাঁরা।

তিন জনপ্রতিনিধির বিষয়ে পুলিশের রূপগঞ্জ অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার আবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় হত্যাসহ অন্যান্য অভিযোগে মামলা হয়েছে। তদন্ত করে যখনই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন তাঁরা সব মামলাতেই জামিনে আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *