আমার নামাজ আমার অনুভূতি
আমার সেজদা আমার নামাজে চুড়ান্ত কাজ। চুড়ান্ত গন্তব্য। সেজদার আগে যত কাজ করা হয়েছে, তাকবীরে তাহরিমা, তেলাওয়াত রুকু, রুকুর পর দাড়ানো সব সেজদাকে উপলক্ষ্য করে। অর্থাৎ সেজদার আগের সকল কাজ সেজদার ভূমিকা মাত্র। আমি আমার রবের সান্নিধ্য চাই। এই সেজদার মাধ্যমে আমি আমার রবের সবচেয়ে কাছে যাই। তাঁর সান্নিধ্য পাই। একজন ইমানদারের সেজদায় যে কী প্রশান্তি পায় তা অন্য কারো উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ইবনুল কাইয়্যেম রাহ. এর ভাষায় সেজদা হল নামাজের গুপ্তধন, সালাতের সবচেয়ে বড় খুটি, রুকুর পূর্ণ পরিসমাপ্তি। সেজদা আল্লাহর বড় প্রিয় ইবাদাত। এক সেজদার আদেশ অমান্য করায় ইবলিশের সব আমল বরবাদ হয়ে চির অভিশপ্ত হয়ে যায়। চির জাহান্ন্ামী হয়ে যায়। অপর দিকে আদম এবং আদম সন্তান এই সেজদার গুনে মহান মালিকের প্রিয় হয়ে যায়। জান্নাতী হয়ে যায়।
বান্দা আল্লাহর নিকটবর্তী হোক, তাঁর কাছে মিনতি জানাক, তাঁর কাছে বিনয়াবনত হোক, আল্লাহ এটা চান। আল্লাহ এটা পছন্দ করেন। যারা আল্লাহর প্রিয় হতে চায় বা প্রিয় হয় তারাও চায় আল্লাহর নিকটবর্তী হতে। আল্লাহর শানে প্রশংসা কৃতজ্ঞতা জানাতে। তাঁর সাথে হৃদয়ের সব আকুতি কাকুতি, সব চাওয়া পাওয়া পেশ করতে। সেজদা হল আল্লাহর কাছে সব কিছু বলার মাধ্যম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় যখন সে সেজদায় থাকে। সব ইবাদাতের মধ্যে নামাজ মূল্যবান কারন নামাজ ছাড়া অন্য ইবাদাত গ্রহনযোগ্য নয়। আর নামাজের মধ্যে সেজদা সবচেয়ে মূল্যবান।
আমি সেজদার আগের সবকাজ একে একে শেষ করে এখন নামাজের চুড়ান্ত পর্যায় সেজদায় লুটিয়ে পড়ছি। আমার আবেগ অনুভূতি, বিনয় ন¤্রতা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা উচিত। মহান প্রভুর মোলাকাতে আমার ধীরতা, স্থিরতা, একাগ্রতা ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা উচিত। হায় আমার দুরবস্তা। নামাজে রুকু আর সেজদায় আমার সবচেয়ে বেশি তাড়াহুড়া। যেন নামাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে না পারলে আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। না না প্রিয় ভাই। বরং নামাজে তাড়াহুড়া করেই আমি ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছি। আমি সেজদা করি এটা কোন ভাবে শয়তান চায় না। তারপরও যখন আমাকে সেজদা থেকে ফেরাতে পারেনি। তাই সে আমার মধ্যে অস্থিরতা, চঞ্চলতা সৃষ্টি করে মহান প্রভু থেকে আমাকে দূরে ঠেলে দিতে চায়। আমি না বুঝে তার মুরিদ হয়ে বসে আছি। আমার পুরো জীবনেও আমি রুকু সেজদা সর্বোপুরি নামাজটা ঠিক করতে পারিনি। যেহেতু নামাজ মহান রবের প্রিয়, তাই নামাজেইতো শয়তান সবচেয়ে বেশি বাধা প্রদান করবে। আমার উপর বিভিন্ন ভাবে আক্রমন চালাবে। আমার নামাজ নষ্ট করতে সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালাবে। তার সকল দোসরদের আমার পিছনে লেলিয়ে দিবে। এটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু আমি যে বেখবর। আফসোস অনেক ইমামও আছেন এখানে বেখবর।
আমি আল্লাহর যত বেশি নৈকট্য চাব আমাকে তত বেশি বিনয়ী হতে হবে। আল্লাহর প্রতি আমার ভালবাসা, আস্থা বিশ্বাস, নির্ভরতা, আল্লাহ ভীতি তত বেশি হতে হবে। এগুলো অর্জন করার জন্য আমাকে সময় শ্রম দিতে হবে। মেহনত করতে হবে। চিন্তা ভাবনা করতে হবে। এগুলো অর্জনের উপায় বের করতে হবে। এই বিষয়ে আমাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আল্লাহকে পেতে আমাকে মরিয়া হয়ে যেতে হবে। বান্দা সেজদায় আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী থাকে। এই সময় মহান মালিক বান্দার দোয়া সবচেয়ে বেশি কবুল করেন। এটা স্বাভাবিক, বন্ধু যখন বন্ধুর নিকটে থাকে তখনি মনের সব কথা খুলে বলে। নিজের চাওয়া পাওয়া, রাগ অনুরাগ, আবেগ উচ্ছ্বাস অনুভূতি সব কিছু নিঃসংকোচে প্রকাশ করে। নিজের দাবী দাওয়া পেশ করে। বিচ্ছিন্নতাতে সে দুঃখিত হয়। মনোক্ষুন্ন হয়, মন ভারাক্রান্ত হয়। বন্ধুর সাক্ষাতকে সে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করে।
আমি এখন সেজদায়। মহান মালিক তার কুদরতি পা আমার সামনে বিছিয়ে দিয়েছেন। আমার মাথা তার পদতলে লুটিয়ে দিয়েছি। আমি রবের সামনে সর্বোচ্চ আত্মসমর্পন করেছি। রবের কাছে আমার সব বিকিয়ে দিয়েছি। তাঁর আদেশ নিষেধ সব কিছু নির্দিধায় মেনে নিয়েছি। আসলে এমনটা হতে পারলে আমি আল্লাহওয়ালা হয়ে যেতাম। আমার কথা আর অনুভুতি আকাশ পাতাল ফারাক। আমার চিন্তা আর কাজের মধ্যে ফারাক বিস্তর। আমার জানা আর মানার মধ্যেও যোজন যোজন দুরত্ব। মহান রব নবী আলাইহিস সালাম ও তাঁর সাথী ইমানদারদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, তাদের চেহারায় সেজদার চিহ্ন ঝলকাবে। এই আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে, যে চেহারায় শুধু সেজদার দাগ থাকবেনা। তাদের চেহরায় ফুটে উঠবে বিন¤্রতা। সেজদায় তারা সবচেয়ে বেশি বিনয়ী হবে। আর সেজদার পরও প্রভু ভক্তিতে তারা বিনয়ী থাকবে।
এখন আমি আমার সেজদার মান নিয়ে চিন্তা করি। সত্যি আমার সেজদা কি উপরের আলোচনার সাথে মিল খায়। নাকি সেজদার জন্য সেজদা করছি। নামাজের জন্য নামাজ পড়ছি। তেলাওয়াতের জন্য তেলাওয়াত করছি। না এর মধ্যে আরো অনেক কিছুর সম্পর্ক রয়েছে। সেজদায় তাড়হুড়া, ইমাম সাহেব সেজদায় একটু বেশী সময় নিলে গলা ঝারা। সেজদার তাসবিহ খুব দ্রুত পড়া। এগুলো হয়েছে আমার সেজদার চরিত্র। আর বিনয় ন¤্রতা এ নিয়ে তো সামান্যতম চিন্তাও করি না। আমার নামাজকে প্রাণবন্ত করতে হলে, সেজদাকে জীবন্ত করতে হবে। সত্যিকার অর্থে সেজদার মাধ্যমে নিজেকে মহান রবের কাছে সপে দিতে হবে। আমার সেজদার মহান রবের কোন প্রয়োজন নেই। বরং মহান রবকে পাওয়ার জন্য আমারই বেশি বেশি সেজদার প্রয়োজন।