আওয়ামী লীগে তবু জাহাঙ্গীরের ছায়া, বিএনপিতে সমন্বয়হীনতা
গাজীপুরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে কেবল জেলা আওয়ামী লীগ চলছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিয়ে। মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় অসন্তোষ বাড়ছে। সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হয়েও মহানগরের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে যাচ্ছেন সাবেক সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর অনুপস্থিতিতে দলীয় কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীর সমাগম কমেছে বলে মনে করেন অনেকে।
গাজীপুরের সব কটি সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের। তাঁদের নেতৃত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। জাতীয় নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়ে নিজ এলাকায় সভা-সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
সাতজন কেন্দ্রীয় নেতা থাকলেও গাজীপুরে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতার চিত্র ফুটে উঠছে। কর্মসূচিতে তৃণমূলের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ছে না। এর মধ্যে মহানগর বিএনপির সভাপতি নিজেকে গাজীপুর-১ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করায় দলীয় কোন্দলের সৃষ্টি হয়েছে।
পূর্ণাঙ্গ কমিটি কেবল জেলা আ.লীগের
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছিল গত বছরের ১৯ নভেম্বর। সম্মেলনে আজমত উল্লা খানকে সভাপতি ও আতাউল্লাহ মণ্ডলকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। আট মাস পরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় পদপ্রত্যাশী নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এক মাসের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন আজমত উল্লা খান।
এ ছাড়া সম্মেলনের আগেই নগরের ৯টি সাংগঠনিক থানা ইউনিটের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কথা ছিল। মাত্র দুটি থানার পূর্ণাঙ্গ কমিটি এবং তিনটি থানার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর থেকে থমকে আছে থানা ইউনিটের কমিটির কাজ।
হালনাগাদ আছে গাজীপুর জেলা কমিটির। ওই কমিটির কার্যক্রম চলে জেলার সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে। জেলা ও মহানগর যুবলীগ সাত বছর ধরে চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। মহিলা লীগ চলছে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিয়ে। কৃষক লীগের মেয়াদ শেষ হলেও কমিটি হচ্ছে না। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। তাঁরা এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গাজীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন বলেন, নির্বাচনের পর এসব কমিটি হালনাগাদ করা হবে। নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় কার্যক্রম চলছে উল্লেখ করে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘নতুন কমিটি গঠন নিয়ে আমরা বিরক্ত। আমরা যেভাবে রাজনীতি করে আসছি, সেই রাজনীতির চর্চা এখন নেই। কোনো সম্মেলন লাগে না, কোনো কিছুই লাগে না। নানা তয়-তদবিরে কমিটি হয়। তাই অন্য কমিটির বিষয়ে নাক গলাতে চাই না।’
বহিষ্কৃত হয়েও আলোচনায় জাহাঙ্গীর
গত ১৫ মে দল থেকে ‘স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত’ হয়েও মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আলোচিত গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। সম্প্রতি ঢাকায় আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে তাঁর নেতৃত্বে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী যোগ দেন। সমর্থকেরা মনে করেন, জাহাঙ্গীর না থাকায় মহানগর আওয়ামী লীগ ঝিমিয়ে পড়েছে। কোনাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আক্কাছ আলী বলেন, জাহাঙ্গীর জানেন কীভাবে দল গুছিয়ে রাখতে হয়। তিনি সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে মহানগর আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত ছিল। আর এখন অগোছালো। সম্মেলনের পর আট মাস হয়ে গেছে, তাঁরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মহানগর আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী আগেও আমার সঙ্গে ছিলেন, এখনো আছেন। আমি তাঁদের নিয়েই দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
তবে আজমত উল্লা খান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি (জাহাঙ্গীর) দলে নেই। তাই মহানগরের রাজনীতিতে তাঁর কোনো প্রভাব থাকতেই পারে না। তিনি যদি দলে ফেরেন, তখন তাঁর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দুই আসনে মনোনয়ন-লড়াই
গাজীপুরের পাঁচটি সংসদীয় আসনের সব কটির সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের। এর মধ্যে দুটিতে মনোনয়ন নিয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেছে।
গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর ও সদর উপজেলার আংশিক) আসনে ইকবাল হোসেন ছাড়াও সাবেক সংসদ সদস্য রহমত আলীর মেয়ে রুমানা আলী (সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য) ও ছেলে জামিল হাসান মনোনয়ন পেতে মাঠে নেমেছেন। গাজীপুর-৫ (কালীগঞ্জ-সদর উপজেলার একাংশ) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি। এই আসনে জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান মনোনয়ন চাইতে পারেন।
গাজীপুর-২ আসনে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল; গাজীপুর-১ আসনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং গাজীপুর-৪ আসনে সিমিন হোসেনের (রিমি) বিপরীতে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী কোনো নেতার কথা শোনা যায়নি।
বিএনপিতে নেতা আছে, সমন্বয় নেই
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে আছেন গাজীপুরের সাতজন নেতা। এরপরও আন্দোলন কর্মসূচি পালনে সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। এর কারণে কর্মসূচিতে তৃণমূলের চোখে পড়ার মতো উপস্থিতি নেই। এরই মধ্যে মহানগর বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন সরকার নিজেকে গাজীপুর-১ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করায় নতুন করে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে এখন আন্দোলন করে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই কেন তিনি নিজেকে গাজীপুর-১ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করেছেন, তা আমরাও জানি না। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ সম্পাদকসহ জেলার কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে।’
শওকত হোসেন সরকার বলেন, ‘আমার সেদিন কথাটা ওইভাবে বলা উচিত হয়নি। আমি নিজেকে দলের একজন ছোট নেতা হিসেবেই ভাবি। আমরা এখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছি।’
জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি থাকলেও সভাপতি আর সম্পাদক দিয়ে চলছে মহানগরের কার্যক্রম। গত জুনে মহানগরে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেখানে সভাপতি নির্বাচিত হন শওকত হোসেন সরকার ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন বিএনপির প্রয়াত নেতা এম এ মান্নানের ছেলে এম মঞ্জুরুল করীম। চার মাস হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি তাঁরা। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে।
গাজীপুরে বিভিন্ন সময়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি অন্তত পাঁচ হাজার। অনেকে জেলে আছেন, কেউ কেউ জামিনে। আবার অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে নেতা-কর্মীদের অনেকে আন্দোলন কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারছেন না বলে মনে করেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী সাইয়েদুল আলম।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ্ রিয়াজুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, জেলা কমিটি এবার নির্বাচনের মাধ্যমে হওয়ায় দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোনো অসন্তোষ নেই। কেন্দ্রীয় বিএনপির যেকোনো আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নিতে তাঁরা প্রস্তুত আছেন। বিভিন্ন কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার কার্যক্রমও চলছে।