Home অপরাধ ১৭ দিনের ব্যবধানে দুই সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় রঞ্জু-রুপা দম্পতি
সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩

১৭ দিনের ব্যবধানে দুই সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় রঞ্জু-রুপা দম্পতি

১৭ দিন আগে রঞ্জু-রুপা দম্পতির ৫ মাস বয়সী ছেলে রিদওয়ান নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই অপহরণের শিকার তাঁদের বড় মেয়ে সামিয়া (৯)। দুর্বৃত্তরা ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অডিও বার্তা পাঠানোর দুই দিন পর বাড়ির পাশেই মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল সামিয়ার গলাকাটা লাশ। ১৭ দিনের ব্যবধানে দুই সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় এই দম্পতি। শোকের ছায়া নেমে এসেছে গ্রামজুড়েই।

রঞ্জু মিয়া ও রুপা আক্তারের বাড়ি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার দাড়িয়াপুর গ্রামে। গত শুক্রবার দুপুরে দাড়িয়াপুর গ্রামের এক বনের পাশের নালা থেকে মাটি খুঁড়ে সামিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে দাড়িয়াপুর উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।

গতকাল শনিবার বিকেলে দাড়িয়াপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রঞ্জু মিয়ার বাড়িতে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমিয়েছে। একে একে গ্রামের বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ তাঁদের প্রতি সমবেদনা জানাতে এসেছেন। ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল সন্ধ্যার আগে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের মর্গ থেকে সামিয়ার লাশ বাড়িতে আনা হয়। এ সময় লোকজনের ভিড় আরও বেড়ে যায়।

কোনো সান্ত্বনাতেই রঞ্জু মিয়া ও রুপা আক্তারে থামছে না। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলের সখীপুরে,

রঞ্জু মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিন্তু আমি তো সান্ত্বনা নিতে পারছি না। আমি তো শান্ত হতে পারছি না। আমার কোলে তো আর তারা ফিরে আসবে না।’ কারা সামিয়াকে অপহরণ করে হত্যা করতে পারে—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এলাকায় মাদকসেবী বেড়ে গেছে। আমার ধারণা, মাদকসেবীরাই আমার মেয়েকে বনের ভেতর ধরে নিয়ে খুন করেছে। যারা আমার মেয়েকে খুন করেছে, তাদের আমি শাস্তি চাই।’

দাড়িয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, এমন ঘটনায় এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সবার এক কথা—এলাকার মাদকসেবীরাই এমন ন্যক্কারজনক ও লোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়েছে। দাড়িয়াপুর উত্তরপাড়া এলাকায় পাকা রাস্তা নেই। কাঁচা রাস্তায় কাদা থাকায় এ গ্রামে পুলিশ আসতে পারে না। চারপাশে বনজঙ্গল। এ পাড়া যেন মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য।

সামিয়ার মা–বাবাকে সান্ত্বনা জানাতে স্থানীয় সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় ২০ থেকে ২৫ জন নেতা-কর্মী নিয়ে দাড়িয়াপুরের খোলাঘাটায় আসেন। সেখান থেকে সামিয়াদের বাড়ি পর্যন্ত আধা কিলোমিটার রাস্তায় কাঁদা থাকায় সংসদ সদস্য আর যেতে পারেননি। পরে নিহত সামিয়ার বাবা-মাকে খোলাঘাটায় ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে রঞ্জু-রুপা দম্পতিকে সমবেদনা জানান সংসদ সদস্য। তিনি সখীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করার সময় বেঁধে দেন। এর আগে দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা আলম ওই বাড়িতে গিয়ে রঞ্জু-রুপা দম্পতিকে সমবেদনা জানান।

স্কুলছাত্রীকে অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি, দুই দিন পর লাশ উদ্ধার

সামিয়া

রঞ্জু মিয়া এক যুগেরও বেশি সময় কুয়েতে প্রবাসজীবন কাটিয়েছেন। করোনার সময় তিনি দেশে ফেরেন। চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাঁর ছিল সুখের সংসার। পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র জানায়, গত বুধবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে সামিয়া বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে প্রাইভেট পড়তে যায়। পড়া শেষে সহপাঠীদের সঙ্গে সে বাড়ি ফিরছিল। পথে একটি দোকানে সহপাঠীরা কেনাকাটা করতে দাঁড়ালে সামিয়া একাই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। এদিকে বাড়ি ফিরতে বিলম্ব হওয়ায় মা রুপা আক্তার শিক্ষককে ফোন দিয়ে জানতে পারেন, তাঁর মেয়ে অনেক আগেই বাড়ি চলে গেছে।

পরে মেয়েকে খুঁজতে বের হলে বাড়ির কাছাকাছি একটি স্থানে মেয়ের ব্যবহৃত জুতা পড়ে থাকতে দেখেন রুপা। এর কিছুক্ষণ পর রঞ্জু মিয়ার মুঠোফোনে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে ইমোতে একটি অডিও বার্তা দেয় দুর্বৃত্তরা। ওই অডিও বার্তা পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর পুলিশ বাড়ির ৪০০ গজ দূর থেকে একটি গহিন বনের পাশে মাটি খুঁড়ে সামিয়ার লাশ উদ্ধার করে।

দাড়িয়াপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, এই ওয়ার্ডে চিহ্নিত ৫০ জন মাদকসেবী রয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন মাদক ব্যবসায়ী। তাদের একটি তালিকা পুলিশকে আগেই দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার পরও পুলিশকে ১০ থেকে ১২ জন মাদকসেবীর নাম দেওয়া হয়েছে। শনিবার বিকেলে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন অব ব্যুরো (পিবিআই) তদন্তে এসে তিনজন মাদকসেবীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে টাঙ্গাইল নিয়ে গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রামের এক শিক্ষক বলেন, সখীপুরের প্রতিটি গ্রামগঞ্জ মাদকে ছেয়ে গেছে। চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ—এসব অপরাধের পেছনে রয়েছে মাদক। মাদক নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল না করতে পারলে সমাজে এসব অপরাধ চলতেই থাকবে।

সখীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সালাউদ্দিন গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, দুর্বৃত্তরা মেয়েটিকে হত্যা করার পর বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে একটি অডিও বার্তা দেয়। এত অল্প সময়ে লাশ এমনভাবে পচে যাওয়ার কথা নয়। উদ্ধার হওয়া গলাকাটা, এক চোখ উপড়ে ফেলা লাশের ধরন দেখে পুলিশ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে। মাদকসেবীদের নজরে রেখে তদন্ত চলছে। অপরাধীরা শিগগিরই ধরা পড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *