Home রাজনীতি গ্যাসের সংকটে সার কারখানা
সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩

গ্যাসের সংকটে সার কারখানা

বিসিআইসির চারটি ইউরিয়া কারখানার তিনটিই এখন বন্ধ।গ্যাসের সংকটে সোমবার বন্ধ হয়েছে সবচেয়ে বেশি উৎপাদনকারী কারখানাটি।

দেশে সাধারণত তিন মাসের জন্য প্রয়োজনীয় সার মজুত থাকে। এখন আছে প্রায় দেড় মাসের চাহিদা পূরণের মতো সার। এরই মধ্যে গ্যাসের সংকটে গত সোমবার বন্ধ হয়ে গেল দেশের সবচেয়ে বেশি সার উৎপাদনকারী কারখানা যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড। এটিসহ এখন বন্ধ তিনটি সার কারখানা।

এমন একটা সময়ে সারের মজুত কম এবং কারখানাটি বন্ধ হলো, যখন চাহিদা অনেক বেশি। দেশে এখন ধানের দ্বিতীয় প্রধান মৌসুম আমনের আবাদ চলছে। জানুয়ারিতে শুরু হবে ধানের প্রধান মৌসুম বোরোর আবাদ। অক্টোবরের শেষ থেকেই শীতকালীন সবজি ও পেঁয়াজের আবাদ শুরু হবে। সাধারণত এই সময়টিতেই সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে।

কৃষক পর্যায়ে এখনো সার নিয়ে সংকট হয়নি। তবে কৃষকদের সার কিনতে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে। গতকাল বুধবার দেশের সাতটি জেলা ঘুরে ছয়টিতে নির্ধারিত দরের চেয়ে কেজিতে ১ থেকে ৩ টাকা বাড়তি দামে সার বিক্রি করতে দেখা যায়।

আমরা সৌদি আরব, কাতার ও আরব আমিরাত থেকে ইউরিয়া সার কেনার যে চুক্তি করেছি, সেই সার দ্রুত চলে আসবে। ফলে সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই।

বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান

ধানখেতে সার ছিটাচ্ছেন কৃষক
ধানখেতে সার ছিটাচ্ছেন কৃষক;

কৃষকেরা বলছেন, এমনিতেই সরকারিভাবে সারের দাম বাড়ানোয় তাঁদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে; তার ওপর নির্ধারিত দরের চেয়ে বাড়তি দাম দিতে বাধ্য হওয়ায় তাঁদের খরচ আরও বাড়ছে। সংকট তৈরি হলে কৃষক পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। যেমন গত বছরের অক্টোবরে কৃষক পর্যায়ে সার সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। তখন কয়েকটি জেলায় কৃষকেরা বাড়তি দাম চাওয়া এবং সার না পাওয়ায় বিক্ষোভ করেছিলেন।

সারকে একটি সংবেদনশীল পণ্য হিসেবে গণ্য করে সরকার সব সময় যথেষ্ট মজুত নিশ্চিত করেছে। সমস্যা তৈরি হয়েছে দেড় বছর ধরে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাওয়ায় সার আমদানিতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। আবার মার্কিন ডলারের অভাবে গ্যাস আমদানি ব্যাহত হওয়ায় দেশেও সার কারখানা পুরো সময় চালানো যায়নি।

দেশে ইউরিয়া সারের মূল জোগান নিশ্চিত করে বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন (বিসিআইসি)। করপোরেশনটির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের সংকট তৈরি হওয়ায় কয়েকটি সার কারখানা আপাতত বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সংকট কেটে গেলে তা আবারও চালু করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা সৌদি আরব, কাতার ও আরব আমিরাত থেকে ইউরিয়া সার কেনার যে চুক্তি করেছি, সেই সার দ্রুত চলে আসবে। ফলে সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই।’

মিউরেট অব পটাশ (এমওপি), ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি), ট্রিপল সুপার ফসফেটসহ (টিএসপি) অন্যান্য সার সরবরাহের বিষয়টি দেখে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। বিএডিসির চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ সাজ্জাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সার আমদানি দ্রুত করার চেষ্টা করছি। চলতি মাসের মধ্যে রাশিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কো থেকে সার আসছে। আশা করি বড় কোনো সংকট হবে না।’

যে তিনটি কারখানা এখন বন্ধ, সেগুলোতে ইউরিয়া উৎপাদিত হতো। গ্যাস না পেয়ে গত সোমবার যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড বন্ধ করে দেওয়া হয়।

মজুত কত, চাহিদা কত

সার
সার,

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে এখন মোট ১৯ লাখ টন সার মজুত আছে। বিপরীতে শুধু চলতি সেপ্টেম্বরের চাহিদা ১২ লাখ টন। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ইউরিয়া সারের মজুত আছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ টন। সেপ্টেম্বরের চাহিদা ৫ লাখ টনের বেশি। সরকারি হিসাবে, আগামী অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে দরকার হবে ১৬ লাখ টন ইউরিয়া সার। ইউরিয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার একটি কারণ হলো, এই সার উৎপাদনের তিন কারখানা এখন বন্ধ।

সরকারি সংস্থা বিসিআইসির ছয়টি সার কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে চারটি ইউরিয়া উৎপাদন করে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই চার কারখানা ১০ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদন করেছিল। যে তিনটি কারখানা এখন বন্ধ, সেগুলোতে ইউরিয়া উৎপাদিত হতো। গ্যাস না পেয়ে গত সোমবার যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বিশ্ববাজারে সারের দাম অনেকটা কমেছিল। এখন আবার বাড়ছে। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে যে ইউরিয়ার দাম প্রতি টনে গড়ে ৬২৩ ডলার ছিল, তা জুনে ২৮৮ ডলারে নামে। আগস্টে তা বেড়ে ৩৮৬ ডলারে উঠেছে।

চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড ও আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের (এএফসিসিএল) মেরামতকাজের জন্য বন্ধ করা হয়েছিল। তবে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি গত মার্চ থেকে উৎপাদনে যেতে পারছে না গ্যাসের অভাবে। আর আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি গত জুন থেকে গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না।

বিসিআইসির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাস পেলেই আমরা সার কারখানা চালু করতে পারব। সব কটি কারখানা চালু করতে পারলে কোনো সার আমদানি করতে হবে না।’

বিসিআইসি বলছে, নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় চালুর অপেক্ষায় থাকা ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে (জিপিএফপিএলসি) পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। এটি উদ্বোধন হওয়ার কথা নভেম্বরের শেষ দিকে। এখন বিসিআইসির অধীনে শুধু শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে ইউরিয়া উৎপাদিত হয়।

যেকোনো মূল্যে সারের প্রাপ্যতা এবং কৃষকদের কাছে সার পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী

আমদানিতে ডলারের অভাব

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারের চাহিদা ধরা হয়েছে ৬৮ লাখ টনের কিছু বেশি। এর প্রায় ৪০ লাখ টন আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বাকিটা দেশের কারখানায় উৎপাদিত হয়।

সার বা গ্যাস—যেটাই আমদানি করা হোক, ডলারের সংস্থান থাকতে হয়। আমদানিতে ডলারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে। ২০২১ সালের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি (৪৮ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার, যা এখন ২ হাজার ৯২১ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ফর্মুলা অনুযায়ী হিসাব করলে মজুত দাঁড়ায় ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে।

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধের সময় ঘনিয়ে আসছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আরও কমবে।

বিশ্ববাজারে সারের দাম অনেকটা কমেছিল। এখন আবার বাড়ছে। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে যে ইউরিয়ার দাম প্রতি টনে গড়ে ৬২৩ ডলার ছিল, তা জুনে ২৮৮ ডলারে নামে। আগস্টে তা বেড়ে ৩৮৬ ডলারে উঠেছে।

ডলারের দাম নিয়মিতই বাড়ছে। গত বছরের মে মাসেও যে ডলার ৮৬ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে, তা এখন ১০৯ টাকা। ডলারের বাড়তি দামও আমদানির ব্যয় বাড়াচ্ছে।

সারে ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের টাকার অভাবও দেখা যাচ্ছে। গত মাসের শুরুতে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিল, আমদানিকারকদের ভর্তুকির ছয় হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে। ফলে অনেকেই আমদানিতে নিরুৎসাহ দেখিয়েছিলেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকা সত্ত্বেও খাদ্যনিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে সার আমদানি করতে হবে। তিনি বলেন, সার না পেলে কৃষি খাতে উৎপাদন ব্যাহত হবে। তাই সার আমদানিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

দাম বেশি

সরকার গত এপ্রিলে ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়ায়। কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা, ডিএপি ১৬ টাকার পরিবর্তে ২১ টাকা, টিএসপি ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা এবং এমওপি ১৫ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা করা হয়।

দেশের সাতটি জেলা ঘুরে গতকাল বুধবার দেখা যায়, নওগাঁয় খুচরা পর্যায়ে কেজিতে ১ থেকে ৩ টাকা বেশি দামে সার বিক্রি হচ্ছে। যেমন নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার লক্ষ্মীডাঙ্গা মোড়ের খুচরা সার বিক্রেতা মোহাম্মদ হোসেনের দোকানে ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ২ টাকা, ডিএপি ১ টাকা এবং টিএসপির দাম ৩ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছিল।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যতীনেরহাট বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও ইউরিয়া প্রতি কেজি ১ টাকা, ডিএপি ২ টাকা, টিএসপি ১ টাকা এবং এমওপি ৩ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে।

সাতক্ষীরা শহরের মেসার্স কৃষিভান্ডারের মালিক মো. সোলায়মান হোসেন জানান, খুচরা বিক্রির সময় প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা বেশিতে সার বিক্রি করেন তিনি।

অবশ্য শেরপুরে বাড়তি দরে সার বিক্রি হতে দেখা যায়নি।

কোনো কোনো কৃষক অভিযোগ করছেন, তাঁদের কাছ থেকে মাঝেমধ্যে আরও বেশি দাম নেওয়া হয়। যেমন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার রাজাবাড়ি গ্রামের রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, স্থানীয় কালীবাড়ি বাজারে তিনি ইউরিয়া, ডিএপি ও এমওপি সার ৩০ টাকা কেজি দরে কিনেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার কাছ থেকে না, সবার কাছ থেকেই বেশি নিচ্ছে। পটাশের (এমওপি) দাম কম থাকে, সেটাও ৩০ টাকা করে নিছে।’

সারের দাম নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি নেওয়ার অভিযোগ আগেও উঠেছিল। গত বছরও সরকার বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে বিক্রেতাদের জরিমানা করেছিল। তবে বেশি নেওয়া এখনো চলছে।

সার ‘নিশ্চিত করতে হবে’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সারের সরবরাহ যখন যথেষ্ট না থাকে, তখন মজুত করা ও দাম বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। তাই কেউ যাতে সুযোগ না নিতে পারে, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো মূল্যে সারের প্রাপ্যতা এবং কৃষকদের কাছে সার পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজার থেকে বেশি দাম দিয়েও যে খাদ্য পাওয়া যাবে না, তার ইঙ্গিত তো এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *