বিদেশিদের প্রচ্ছন্ন হুমকিতে কাজ হবে না
এদিকে ড. ইউনূসের বিচার নিয়ে বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিবৃতির প্রতিবাদ জানিয়েছে আইনজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন সংগঠন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কড়া বিবৃতি
বেশ কয়েক দিন ধরে প্রচারণার পর গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ড. ইউনূসের বিচার প্রসঙ্গে দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তির একটি যৌথ চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল রাতে এক বিবৃতিতে বলেছে, রাজনৈতিক নেতাসহ একদল আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব এবং কিছু বাংলাদেশি নাগরিক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রমের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, খোলা চিঠিতে তথ্যের সুস্পষ্ট ঘাটতি থাকার বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে। আর এটি বাংলাদেশের স্বাধীন বিচারব্যবস্থার প্রতি অবমাননাকর। চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা চলমান মামলার যোগ্যতা ও বিচারিক কার্যক্রমের ফলাফল সম্পর্কে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন।
বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর সুনির্দিষ্ট বিধানের অধীনে এমন একটি মামলা করেছে। গ্রামীণ টেলিকম লিমিটেডের লাভের টাকা আত্মসাতের বিষয়ে শ্রমিক ও কর্মচারীদের অভিযোগ তদন্তের ভিত্তিতে মামলাটি করা হয়েছিল। দুদকের তদন্তদল দেখতে পেয়েছে, ২৫ কোটি ২০ লাখ টাকা আত্মসাত্ এবং অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য গ্রামীণ টেলিকম লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্যান্য বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে মিলে জাল চুক্তি করেছেন। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ঢাকা বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর অধীনে একটি মামলা করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, কর ফাঁকির মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে হেরে যাওয়ায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগে আবেদন করেন। হাইকোর্ট বিভাগের আদেশে আপিল বিভাগ কোনো দুর্বলতা ও বেআইনি বিষয় খুঁজে না পেয়ে আবেদনটি খারিজ করে দেন। এরপর ড. ইউনূস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বকেয়া কর পরিশোধ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কর ফাঁকির আরো কয়েকটি মামলা রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শ্রমিকদের তাঁদের ন্যায্য লাভ থেকে বঞ্চিত করার মামলায় ড. ইউনূস দুই দফায় সর্বোচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন। একটি ‘মেইনটেবিলিটিকে’ চ্যালেঞ্জ করে এবং আরেকটি বিচারিক আদালত কর্তৃক অভিযোগ গঠনকে চ্যালেঞ্জ করে। তাঁর আইনজীবীদের শুনানি করে সর্বোচ্চ আদালত প্রথম মামলাটি সঠিকভাবে শুরু হয়েছে বলে নিশ্চিত করে রায় দেন। অন্যটিতে অভিযোগ গঠনকে আইনি, সঠিক ও যথার্থ বলে ঘোষণা করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, খোলা চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা বিচারাধীন মামলাগুলো স্থগিত করতে প্রধানমন্ত্রীকে বিচারবহির্ভূত কর্তৃত্ব প্রয়োগ করার অনুরোধ করেছেন। এটি দুঃখজনক। তাঁরা ড. ইউনূস ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পর্যালোচনার এমন বিকল্প প্রক্রিয়ার সুপারিশ করেছে, যা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সহযোগীরা তাঁদের অভিযুক্ত বা আইন লঙ্ঘনের প্রমাণিত ঘটনার আইনি পরিণতি এড়াতে আন্তর্জাতিক লবিংয়ের আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। গ্রামীণ ব্যাংক সার্ভিস রুলস, ১৯৯৩-এ নির্ধারিত অবসরের বয়স অতিক্রম করায় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাঁর চুক্তি বাতিল করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্তটি তাঁরই ছিল।
ড. ইউনূস প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, একটি সার্বভৌম দেশের নাগরিকের জন্য বারবার বাইরের হস্তক্ষেপ চাওয়াটা অগ্রহণযোগ্য। সম্ভবত তাঁর ধারণা, তিনি দেশের আইনের ঊর্ধ্বে। আর এই ধারণার ভিত্তিতে তিনি এগুলো করছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের কাছে এটি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে করপোরেট কর ও আয়কর ফাঁকি দিয়ে এবং বছরের পর বছর কর্মীদের বঞ্চিত করে গ্রামীণ ব্যাংকের বেতনভোগী কর্মচারী ড. ইউনূস সম্ভবত আত্মসাৎ ও পাচার করা অর্থের বড় অঙ্ক বাণিজ্যিক উদ্যোগে বিনিয়োগ করেছিলেন।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ‘নিপীড়ন বা হয়রানির’ অভিযোগগুলো মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে আবরণ হিসেবে ব্যবহার করে শিকারের মানসিকতা থেকে উদ্ভূত বলে সরকারের কাছে মনে হয়েছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে অযৌক্তিক ইঙ্গিত দেওয়ার পরিবর্তে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আইনের সীমারেখার মধ্যে কাজ করতে বলাই চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের জন্য ভালো পরামর্শ হবে। বাংলাদেশ সরকার আবারও জানাতে চায়, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রসারের অজুহাতে প্রচ্ছন্ন যেকোনো ধরনের হুমকি বাংলাদেশের জনগণকে আইনের শাসন বজায় রাখা থেকে বিরত করবে না।
১৩টি জাতীয় ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা নিয়ে বিভিন্ন দেশের ১৬০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিবৃতির প্রতিবাদ জানিয়ে দেশের ১৩টি জাতীয় ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বলেছে, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে বিদেশিদের বিবৃতি অগ্রহণযোগ্য।
সংগঠনগুলো ওই বিবৃতির সঙ্গে বাংলাদেশবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্র যুক্ত রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতেও সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। বিবৃতিদাতা সংগঠনগুলো হচ্ছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদ, অভিনয় শিল্পী সংঘ, বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার ও বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট।
১৭১ বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রতিবাদ
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিতের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের লেখা খোলা চিঠির প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের ১৭১ জন বিশিষ্ট নাগরিক। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তাঁরা এ প্রতিবাদ জানান।
বিবৃতি দাতাদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, শিল্পী হাশেম খান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমামসহ দেশের ১৭১ জন বিশিষ্ট নাগরিক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী।
হস্তক্ষেপ বলছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারে খোলা চিঠির প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। গতকাল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজউদ্দীন ফকির ও সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুন নূর দুলালের সই করা বিবৃতিতে বলা হয়, কয়েকজন নোবেল বিজয়ী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের সদস্য অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন। তাঁরা প্রকৃত সত্য জানলে এই চিঠি দিতেন না।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মনে করছে, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের মধ্য দিয়েই এ বিচারকার্য চলছে। বিচার কার্যক্রমের কোনো পর্যায়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যদি সংক্ষুব্ধ হন, তাহলে তাঁর আইনি প্রতিকার বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেই রয়েছে।