রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টি আবারও বেপরোয়া
অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা আবারও বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে নগদ টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তাদের খাওয়ানো নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিষক্রিয়ায় আবার কেউ কেউ প্রাণও হারাচ্ছেন। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের কারণে অজ্ঞানপার্টির অপকর্মে কিছুদিন ভাটা পড়েছিল। এখন ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তারা। বিশেষ করে বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল, রেলস্টেশন এবং বিমানবন্দরসহ অর্ধশত স্পটে তৎপর তাদের বিশেষ ট্রেনিং পাওয়া সদস্যরা। পথে-ঘাটে টার্গেট করা ব্যক্তিকে বাগে আনতে কখনো যাত্রী, কখনো হকার, কখনো বা সাধারণ ক্রেতা কিংবা বিক্রেতার বেশ ধরে তারা। যাত্রীবাহী বাস, ট্রেন, লঞ্চ, ফেরি-ফেরিঘাট, বাস টার্মিনাল রেলস্টেশন কোথাও নিরাপদ নয় লোকজন। মহানগরীর গুলিস্তান, গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনালসহ জনাকীর্ণ এলাকায় পথচারী ও যাত্রীদের অজ্ঞান করে সর্বস্ব হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা জানায়, অজ্ঞান পার্টি চক্রের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান নেই। তবে পুলিশের দাবি, ভুক্তভোগীদের অনেকেই থানায় অভিযোগ করেন না। অভিযোগ না করায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ারও তেমন সুযোগ থাকে না। বিশেষজ্ঞরা বলছে, সচেতনতার বিকল্প নেই। সচেতন থাকলে অজ্ঞান পার্টির খপ্পর থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সেখানে চিকিৎসার জন্য যায়। জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সাত মাসে দুশতাধিক মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে চিকিৎসা নিয়েছে। এদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পুলিশ বলছে, এদের দৌরাত্ম্য থামাতে পুলিশের একটি বিশেষ দল মাঠে কাজ করছে। অনেককে ধরে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে তাদের কোনোভাবেই নির্মূল করা যাচ্ছে না। এজন্য পথচারী বা যাত্রী সবাইকে সতর্ক হতে হবে। অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত হয় আমদানি নিষিদ্ধ চেতনানাশক ওষুধ। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি নিষিদ্ধ চেতনানাশক ওষুধে সয়লাব পুরো মিডফোর্টের ওষুধ মার্কেট। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওইসব বিক্রি করছেন অপরাধীদের কাছে। অনেক সময় অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা দ্রুত টার্গেট করা ব্যক্তিকে অজ্ঞান করতে অতিমাত্রায় চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। কখনো দেখা যায় অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়া ব্যক্তি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। তার আচার-আচরণ ও চলাফেরা অস্বাভাবিক হয়ে গেছে।
যেভাবে অজ্ঞান করা হয়: পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মিজান নামে অজ্ঞান পার্টির এক হোতা জানিয়েছে, রিবট্রিল ও মিলিয়াম জাতীয় ঘুমের ট্যাবলেট গুঁড়ো করে তা চ্যবন প্রাশ ও খোরমার সাথে মিশিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ হালুয়া। যা খেলে মানুষের নেশা ও ঘুম আসে। অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মাত্রা বেশি হলেও মারাও যায়। যৌনশক্তি বৃদ্ধি ও পেটের সমস্যার উপশমের কথা বলে বিভিন্ন জায়গায় এই বিশেষ হালুুয়া বিক্রি করে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রথমে তারা কোনো ব্যক্তিকে টার্গেট করে তাকে হালুয়া খেতে প্রলুব্ধ করে। খাওয়ার পর ঐ ব্যাক্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে সবকিছু নিয়ে সটকে পড়ে চক্রের সদস্যরা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশিদ বলেছেন, এরা ভ্রাম্যমাণ অপরাধী। তাদের খাওয়ানো নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিষক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। রাস্তায় এমন কোনো দ্রব্য না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সচেতন থাকতে হবে সবাইকে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে পুলিশ জানায়, গ্রেফতারকৃত অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সংঘবদ্ধভাবে বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান করে এবং তারা পূর্ব থেকেই হামদর্দ এর চ্যাবন প্রাসে নেশা জাতীয় ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে রাখে। ঢাকা সিটির লোকাল বাসে উঠে নিদিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করে তাদের সদস্যদের একজন ঐ ব্যক্তির পাশে বসে। অন্যরা সামনে পিছনের সিটে বসে তাকে ফলো করে। তাদের মধ্যে একজন হকার সেজে ক্যানভাস করতে থাকে। ক্যানভাসের সময় উক্ত হকার বাসে অবস্থান করা যাত্রীবেশী একই চক্রের সদস্যদের তারা হালুয়া খেতে দেয় এবং টার্গেট ব্যক্তিকে হালুয়া খেতে উৎসাহিত করে। উক্ত হকার টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে ফ্রিতে একটি হালুয়া খেতে দেয়। টার্গেট ব্যক্তি হালুয়া খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেলে আশপাশে থাকা অজ্ঞান পাটির সদস্যরা টার্গেট ব্যক্তির সর্বস্ব হাতিয়ে নেয় এবং নিকটবর্তী স্ট্যান্ডে নেমে যায়।
কয়েকটি ঘটনা: রাজধানীতে অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে মো. শিবলু হোসেন (৪০) নামের এক ব্যক্তির তিন লাখ টাকা খোয়া যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১০ আগস্ট বিকেল ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। শিবলু তৌফা ট্রেডিং নামের একটি কোম্পানির ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। বিকেল ৫টার দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। তার সহকর্মী বিদ্যুৎ বলেন, বাড্ডার নাগদারপাড় এলাকা থেকে বাসে করে দোকানের মালামাল কেনার জন্য যাওয়ার পথে বাসের মধ্যে অজ্ঞানপার্টি সদস্যরা তাকে কিছু খাইয়ে অচেতন করে। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে পাকস্থলী ওয়াশ করে নতুন ভবনে মেডিসিন ওয়ার্ডের ভর্তি করা হয়। এদিকে গত ৯ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়া কলেজছাত্র জসিম কুমার সাহা (২৪) মারা গেছেন। সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এর আগে দুপুর দেড়টার যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়েন তিনি। পরে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। জসিম সাহার ভাই অসীম কুমার সাহা বলেন, আমার ভাই নারায়ণগঞ্জ কদমরসুল কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। দুদিন আগে বন্ধুদের সঙ্গে সিলেটে ঘুরতে গিয়েছিল।
অন্যদিকে যাত্রাবাড়ীতে অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ (৬০) নামে এক সৌদি প্রবাসীর সর্বস্ব খোয়া গেছে। ৮আগস্ট রাত পৌনে ৮টার দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিয়ে যাওয়া হয়। যাত্রাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ তসলিম হোসেন বলেন, আমরা খবর পেয়ে যাত্রাবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির সামনে থেকে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করি। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। তিনি আরও জানান, ওই প্রবাসীর কাছে থাকা পাসপোর্ট থেকে জানতে পারি যে, তিনি সৌদি প্রবাসী। এ দিস সৌদি থেকে ঢাকায় আসেন। এয়ারপোর্ট থেকে আসার পথে অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা তাকে অচেতন করে তার কাছে থাকা টাকা ও লাগেজ নিয়ে যায়। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলা কচুয়া থানায়। এছাড়া গত ৬ আগস্ট শাহজাদপুর এলাকায় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে মো. শাহরিয়ার (৩৫) নামের রবি কোম্পানির মার্কেটিং সুপারভাইজারের সর্বস্ব খোয়া গেছে। দুপুর ২টার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে। অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হয়।