ইমরান খান গ্রেফতার
বে আইনিভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি নিজের কোষাগারে জমার রাখার দায়ে গতকাল শনিবার ৩ বছরের কারাদ- দেওয়া হয় পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) চেয়ারম্যানকে। একইসঙ্গে আদালত ইমরান খানকে আরও ১ লাখ রুপি জরিমানাও করেছেন। এরপরই বিচারক সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে অবিলম্বে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে তার আইনজীবী ইন্তাজার হুসেন তাক্ষণিকভাবে রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বাড়ি থেকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
বিচারক হুমায়ুন দিলাওয়ার বলেন, ইমরান খান নির্বাচন কমিশনে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। দুর্নীতির চর্চায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।’
ফলে নির্বাচন আইনের ১৭৪ ধারায় পিটিআইয়ের প্রধানের বিরুদ্ধে ৩ বছরের সাজা ঘোষণা করেন।
পিটিআই পাঞ্জাব এক টুইটবার্তায় নিশ্চিত করে জানিয়েছে, ইমরান খানকে কোট লাখপত কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। তার আইনজীবী দল বলেছে, এই রায়ের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আপিল করতে যাচ্ছেন তারা।
পিটিআইয়ের অভিযোগ, রায় ঘোষণার আগেই তাকে অপহরণ করতে বাসায় পৌঁছে যায় পুলিশ।
নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এ দিন সকাল থেকে আদালতের বাইরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এর আগে আল কার্দির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গত ৯ মে ইসলামাবাদ আদালতের প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেফতার হন তিনি। অবশ্য শনিবার তার অনুপস্থিতিতেই রায় ঘোষণা করা হয়।
তোশাখানা মামলা
গত বছর ক্ষমতাসীন জোটের আইনপ্রণেতারা বলেছিলেন, ইমরান খান তোশাখানা থেকে (প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন) যে উপহারগুলো রেখেছিলেন, তা বিক্রি থেকে আয় যা করেন, তার বিবরণ তিনি কাউকে জানাননি। সে বছরের ২১ অক্টোবর পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) জানায়, ইমরান খান সত্যিই উপহার সম্পর্কে মিথ্যা বিবৃতি ও ভুল তথ্য দেন।
তোশাখানা হলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীন একটি বিভাগ, যা অন্যান্য সরকার প্রধান ও বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের শাসক ও সরকারি কর্মকর্তাদের দেওয়া উপহার সংরক্ষণ করে। তোশাখানার নিয়ম অনুসারে, উপহার ভেদে একটা নির্দিষ্ট অর্থ জমা দিয়ে প্রাপ্ত উপহার নিজের কাছে রাখা যায়।
অনেক বছর ধরেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশ্বাস ছিল দেশের জন্য একজন ‘ত্রাতা’ খুঁজে পেয়েছে তারা। এ ত্রাতা হলেন ইমরান খান। কিন্তু লেখক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ হানিফ লিখেছেন, ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার এক বছরের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে, সেই ইমরান খানই সেনাবাহিনীর ‘চিরশত্রু’ হয়ে উঠছেন। ইমরানের আক্রোশ থেকে বাঁচতে সেনাবাহিনীও সর্বশক্তি ব্যবহার করছে।
ইমরান খান ও তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফের (পিটিআই) বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ধরপাকড় ও সাঁড়াশি অভিযান চলছে। এতে পুরো পাকিস্তানই স্থবির হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে।
নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে ভুগছে পুরো পাকিস্তানের লোকজন। তীব্র গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। দেশটির ইতিহাসে এবার গ্রীষ্মকাল সবচেয়ে উষ্ণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎবিভ্রাট। বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। এ পরিস্থিতির মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম রাজনৈতিক সংকট। ইমরান এরপর কী করবেন, তাকে ঠেকাতে সেনাবাহিনী কী পদক্ষেপ নেয়, সেই চিন্তাই গ্রাস করেছে পুরো জাতিকে।
এক বছরের বেশি সময় আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন ইমরান খান। তাঁর সমর্থকেরা হুমকি দিয়ে আসছিলেন, ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হলে দেশে আগুন জ্বলবে। কয়েকবারের ব্যর্থ চেষ্টার পর ৯ মে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করে আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা।
ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করার পরে পুরো দেশ না জ্বললেও সেনানিবাস পর্যন্ত সহিংসতা হয়েছে। পাকিস্তানের সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা মনে করা হয় দেশটির সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরকে, যেটি জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স (জিএইচকিউ) নামে পরিচিত। ইমরান খানের দলের কর্মী ও সমর্থকেরা সেই সেনা সদর দপ্তরে ঢুকে, সেনাবাহিনীর পতাকাসংবলিত সাইনবোর্ড খুলে ফেলেছিল।
লাহোরে সেনাবাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ জেনারেলের বাসভবনে আগুন দেওয়া হয়। জেনারেলের বাড়ির আসবাব ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার সময় সেই দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করতে দেখা যায় ইমরান খানের সমর্থকদের। জেনারেলের সামরিক পোশাক পরে এক বিক্ষোভকারীকে ওই বাড়ি থেকে বের হতে দেখা যায়। আরেকজনকে দেখা যায়, জেনারেলের পোষা ময়ূরটি নিয়ে যাচ্ছেন।
দেশটির প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। তাঁর মেয়ে বেনজির ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে দুবার অপসারণ করা হয়। পরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় তিনি নিহত হন। হামলাকারী ছিল একজন কিশোর। সে ঘটনার পূর্ণ তদন্ত কখনো হয়নি। আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকেও অপসারণ করা হয়েছিল। এরপর তিনি কারাগারে ছিলেন, পরে নির্বাসিত হন। এখনো বিদেশে আছেন। নওয়াজের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তার মাধ্যমে নওয়াজই কার্যত দেশ চালালেও তিনি এখনো পাকিস্তানে ফিরতে পারেননি।
ইমরান খানের কর্মী সমর্থকদের এ কর্মকা-ে বিপ্লবের সব নমুনা থাকলেও তা ‘বিপ্লব’ ছিল না। সেনাবাহিনী প্রথম ইমরানকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিলেও পরে তাঁকে দূরে ঠেলে দেয়। এখন তাঁর সমর্থকেরা প্রতিশোধ নিচ্ছেন। একে বিপ্লব বলা যায় না, হতে পারে খুনসুঁটিমূলক ঝগড়ার বেশি।
ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর সমর্থকেরা যা করেছেন, এর আগে কোনো মূলধারার রাজনৈতিক শক্তিকে তা করতে দেখা যায়নি। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে বিক্ষোভ করার পরিবর্তে তারা সেনানিবাস এলাকায় আক্রমণ করে এবং পাকিস্তানের জেনারেলরা কীভাবে জীবন যাপন করছেন, তা নাগরিকদের দেখান (বিশাল প্রাসাদ, সুইমিং পুল আর কয়েক একর জমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ময়ূর)।
ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুক্ষণ আগে এক বক্তব্যে ইমরান খান এই ইঙ্গিত দেন, সেনাপ্রধান আসিম মুনির হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি পিটিআইকে ধ্বংস করতে চাইছেন।
ইমরান খান শিবিরের অভিযোগ, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। একাধিক মতামত জরিপে উঠে এসেছে, এই নির্বাচন হলে ইমরান খানেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বর্তমান জোট সরকারে থাকা দলগুলোর অনেক রাজনীতিক ইমরানের দল পিটিআইকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন।
অতীতে দেখা গেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখনই বেসামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছে, তারা কোনো না কোনো একটা উপায় বের করেছে।
অন্যদিকে ইমরান খান তার কর্মী সমর্থকদের ‘দাসত্বের বদলে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে’ বলেছেন। এতে একটা অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। আগেও এমন রাজনৈতিক অচলাবস্থায় ভুক্তভোগী হয়েছেন সাধারণ মানুষ। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।