চিড়েচ্যাপ্টা আবাসন— নাগালের বাইরে চলে যাবে প্লট-ফ্ল্যাট
চাপে চ্যাপ্টা দশা দেশের আবাসন খাতের। এ খাতে বড় আঘাত ঢাকার ভবনের উচ্চতা অস্বাভাবিক মাত্রায় কমানো। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নির্মাণসামগ্রীর দাম। নির্মাণ-ব্যয় প্রায় দি¦গুণ হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার জমি, বাড়ি, স্থাপনা, ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেস হস্তান্তরে উৎসে কর প্রায় ২৪ গুণ বেড়েছে।
সবার জন্য আবাসন রাজনৈতিক অঙ্গীকার হলেও এ ক্ষেত্রে তা মনে রাখছে না সরকার। এ খাতের সংকট নিরসনে সরকার উদ্যোগ না নিলে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের নিজস্ব আবাসন নাগালের বাইরে চলে যাবে; বাড়বে বাড়ি ভাড়া। বিনিয়োগকারীরা এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে; উচ্চবিত্ত মানুষের প্লট-ফ্ল্যাটের চাহিদা থাকলেও মিলবে না। এতে টাকা পাচার বাড়বে, কমবে রাজস্ব। আবাসন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২১১ শ্রেণির লিংকেজ শিল্পের ১০ থেকে ১৫ হাজার প্রতিষ্ঠানের প্রায় এক কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়তে পারে। দরিদ্র মানুষরা ঢাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে। আবাসন খাতে চরম অস্থিরতা দেখা দেবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
জমি, বাড়ি, স্থাপনা, ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্লোর স্পেস হস্তান্তরের কর আগে ছিল ৪ শতাংশ; সেটা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮ শতাংশ। এলাকাভেদে জমির কাঠাপ্রতি ২০ লাখ, ১২ লাখ, ৮ লাখ, ৬ লাখ ও ৩ লাখ টাকা কর নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে যেটার পরিমাণ বেশি সেটা সরকারকে দিতে হবে। করের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৪ গুণ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সিমেন্ট তৈরির প্রধান কাঁচামাল ক্লিঙ্কারের আমদানি শুল্ক ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা করা হয়েছে। আর বাণিজ্যিক পর্যায়ে ক্লিঙ্কারের আমদানি শুল্ক ৭৫০ থেকে বাড়িয়ে ৯৫০ টাকা করা হয়েছে। আবাসন খাতের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলোর দাম গত চার বছরে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ২০২০ সালে রডের টনপ্রতি দাম ছিল ৬৪ হাজার ৪০০, ২০২১ সালে বেড়ে হয় ৭০ হাজার, ২০২২ সালে দাম ছিল ৯০ হাজার, এখন রডের টনপ্রতি দাম ১ লাখ টাকার বেশি। ২০২০ সালে এক ব্যাগ সিমেন্টের দাম ছিল ৩৭৫ থেকে ৪০৫, ২০২১ সালে হয় ৩৯০ থেকে ৪২৫, ২০২২ সালে ৪৭৫ থেকে ৫৬০ এবং বর্তমানে ৫০০ থেকে ৫৬০ টাকা। ২০২০ সালে প্রতিটি ইটের দাম ছিল ৬ থেকে ৮ টাকা, ২০২১ সালে দাম হয় ৯ থেকে ১০, ২০২২ সালে ১০ থেকে ১২ এবং বর্তমানে ১৩ থেকে ১৫ টাকা। ২০২০ সালে ভবনের প্রতি বর্গফুট নির্মাণে শ্রমিক খরচ ছিল ১৪০, ২০২১ সালে হয় ১৬০, ২০২২ সালে ২২০ এবং বর্তমানে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। একইভাবে দাম বেড়েছে লাল বালু, সাদা বালু, থাই অ্যালুমিনিয়াম, গ্রিল, রেলিং, ইলেট্রিক্যাল-ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও স্টেশনারির দাম।
ঢাকার জন্য প্রণীত প্রথম মাস্টারপ্ল্যানের মেয়াদ শেষে ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট তার সংশোধিত গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এ প্ল্যানে দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা বিবেচনা না করেই অস্বাভাবিকভাবে ভবনের উচ্চতা কমিয়ে দেওয়া হয়। যেসব এলাকায় আগে ১০ তলা, ১২ তলা বা তার চেয়ে বেশি তলাবিশিষ্ট ভবন করা যেত, এখন সেখানে চার থেকে পাঁচতলার বেশি উঁচু ভবন নির্মাণ করা যায় না। নতুন মাস্টারপ্ল্যান গেজেট আকারে প্রকাশের পর নতুন ভবনের নির্মাণ অনুমোদন করছেন না আবাসন ব্যবসায়ীরা। পুরাতন নিয়মে নেওয়া অনুমোদনে নির্মাণকাজ চলছে। অংশীজনদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ জানুয়ারি ঢাকার নতুন মাস্টারপ্ল্যান বা ড্যাপের রিভিউ সংক্রান্ত ১১ সদস্যের কারিগরি কমিটি হয়েছে। রাজউক ড্যাপ সংশোধনে গড়িমসি করছে।
এ প্রক্রিয়া জোরদার করতে গত ২৮ মার্চ গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের কাছে চিঠি দিয়েছেন আবাসন ও হাউজিং ব্যবসায়ীরা। প্রতিমন্ত্রী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে মাস্টারপ্ল্যান সংশোধন করে ভবনের উচ্চতা বাড়ানোর অঙ্গীকার করলেও তিন মাসের বেশি সময় পরও তা সংশোধন করা হয়নি। ঢাকার খিলক্ষেত, কুড়িল, নিকুঞ্জ এলাকায় ছয়তলা, উত্তরায় সাত-আটতলা, গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায় ছয়-আটতলা, নিকেতনে চার-পাঁচতলা, মিরপুর এলাকায় চার-সাততলা, মোহাম্মদপুর-লালমাটিয়া এলাকায় পাঁচ-আটতলা, পুরান ঢাকায় চার থেকে পাঁচতলার বেশি ভবন নির্মাণ করা যাবে না। ঢাকার বাড্ডা ও আশপাশ এলাকায় দুই থেকে তিনতলা ভবন নির্মাণ করা যাবে।
এ প্রসঙ্গে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রেসিডেন্ট আলমগীর সামসুল আলামিন (কাজল) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সংকটে বিপর্যস্ত দেশের আবাসন খাত। রাজউক মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে ভবনের উচ্চতা কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে আবাসন খাতের প্রকল্প কমে গেছে; নতুন নিয়মে কোনো প্রকল্পই নিচ্ছেন না ডেভেলপাররা। কারণ বিদ্যমান উচ্চতায় প্রকল্প নিয়ে তেমন লাভ করা যাবে না। প্রকল্প করলে ভবন মালিক ও ব্যবসায়ী দুপক্ষেরই ক্ষতি।’
তিনি বলেন, ‘নতুন বছরের বাজেটে জমি, ভবন ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের কর বাড়ানো হয়েছে। এটা সংশোধন করা না হলে প্লট ও ফ্ল্যাট মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে; অনেকে বেকার হয়ে পড়বে। সরকারের উচিত সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।’
এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের আবাসন খাতসংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আবাসন খাত তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এক. নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি; দুই. ড্যাপের বিধিনিষেধে ভবনের উচ্চতা কমে যাওয়া এবং তিন. চলতি বছরের বাজেটে প্লট-ফ্ল্যাটের হস্তান্তর কর বাড়ানো। এসবের প্রভাবে আবাসন খাত বিপর্যস্ত। এর প্রভাব অর্থনীতিতেও পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় চার বছর আগে প্লট-ফ্ল্যাটের হস্তান্তর কর কমাতে এনবিআর একটি কমিটি করেছিল। ওই কমিটির সদস্য ছিল রিহ্যাব, এফবিসিসিআই, পূর্ত মন্ত্রণালয় ও এনবিআর। কিন্তু সরকার সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে হঠাৎ হস্তান্তর কর চারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে; যার সামগ্রিক প্রভাব প্রায় ২৪ গুণ।’