প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়া
পুলিশি তদন্তে ভাটা পড়ার সুযোগে সারা দেশে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে অনলাইনে জুয়া চক্রের সদস্যরা। মোস্টবেট নামে একটি অনলাইন জুয়ার সাইট এরই মধ্যে বাংলাদেশকে টার্গেট করে প্রচারণা চালিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অনলাইন জুয়াড়িদের এ সিন্ডিকেট মূলত করোনা মহামারীর সময় গোপনে বিভিন্ন ধাপে এজেন্ট নিয়োগ করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছিল। আর সেই অর্থ বিদেশে পাচারের তথ্যও উঠে আসে।
পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে। বিভিন্ন এলাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে আটজনকে গ্রেপ্তার করেন সিআইডি কর্মকর্তারা। ২০২১ সালে সিআইডির এ অভিযানে পর মোস্টবেটের তৎপরতা থেমে যায়। অন্যদিকে সিআইডির তদন্ত কার্যক্রমেও ভাটা পড়ে, যা এখনো গতি পায়নি। আর এ সুযোগে ধীরে ধীরে আবারও সক্রিয় হয় মোস্টবেট। ২০২১ সালে একইভাবে বেশ কিছু জুয়ার সাইটের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি)। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাইবার শাখাসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। তখন দেশে অনলাইন জুয়ার অবৈধ কর্মকাণ্ড অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে ওই জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠানগুলো। ইউটিউব, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে চালানো হচ্ছে প্রচারণা। আবার প্রচারের জন্য বানানো কনটেন্ট বিভিন্ন অঞ্চল ও উঠতি বয়সীদের টার্গেট করে বুস্ট করাও হচ্ছে ব্যাপকভাবে। ফলে অনেকেই জুয়ায় আসক্ত হয়ে একদিকে তারা যেমন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে, অন্যদিকে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা পাচার হচ্ছে বিভিন্ন দেশে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনস দলের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জুয়ার বিভিন্ন সাইটের বিরুদ্ধে করা মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ ছাড়া নতুন করে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া জুয়ার সাইটগুলো আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। শিগগিরই আমরা এসব জুয়ার সাইটের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করব।’
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে তারা পাঁচটি মামলার তদন্ত করছেন। একটির তদন্ত শেষ হয়েছে, শিগগিরই আরও দুটি মামলার তদন্ত শেষ হবে। এ ছাড়া ওয়ানএক্সবেট, মোস্টবেটের মতো বেশ কিছু সাইট নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। বর্তমানে জনপ্রিয় শতাধিক জুয়ার সাইট চলমান রয়েছে। জুয়ার সাইট মোস্টবেটের বিষয়ে জোরালোভাবে তদন্ত চলছে বলে জানান তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোস্টবেটের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা বর্তমানে জামিনে রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, জামিনে বের হয়ে তারা আবারও জুয়া পরিচালনায় যুক্ত হয়েছে। তদন্তে এ জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠানটির তিনজন হোতাকে শনাক্ত করা হয়েছে। যারা মূলত এ সাইট পরিচালনায় পেছন থেকে কাজ করছে। তবে তারা এখন রাশিয়ায় অবস্থান করছে। এজন্য তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
সিআইডি জানিয়েছে, জুয়ার সাইটগুলোর মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা পাচারের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা হুন্ডি, ক্রিপ্টোকারেন্সিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা পাচার এবং লেয়ারিং (অর্থ পর্যায়ক্রমে জটিল লেনদেনের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরে সরিয়ে অর্থের উৎস গোপন) করেছে। অর্থ পাচারের তদন্তের জন্য নির্ধারিত ইউনিট সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম। অর্থ পাচারের প্রাথমিক প্রমাণের তথ্য তাদের পাঠানো হয়েছে। তবে এসব জুয়ার সাইটের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত শুরু করেনি সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।
গত বছর সংশ্লিষ্টরা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, মোস্টবেটে ব্যবহার করা কিছু মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের লেনদেন পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ডিএফআইইউ)। গত বছর জানুয়ারি থেকে ছয় মাসের লেনদেনে দেখা যায়, প্রতিটি এমএফএস অ্যাকাউন্টে মাসে গড়ে ৫০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী নমুনায় থাকা পাঁচটি নম্বরে ছয় মাসে নেওয়া হয়েছে আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, এভাবে শতকোটি টাকা একটি সাইটের মাধ্যমেই নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মোস্টবেটের সঙ্গে জড়িত একজনকে গ্রেপ্তারের পর সে প্রায় ১ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।
সাইবার পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, প্রথমে জুয়াড়িরা এমএফএসের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে জুয়া সাইটের নিজস্ব কারেন্সি কেনে। এরপর সেই টাকা এমএফএসের ডিএসওর সঙ্গে যোগসাজশ করে ক্যাশ (নগদায়ন) করে জুয়ার এজেন্ট। পরে এজেন্ট চক্রের মূল হোতারা নিয়ন্ত্রিত লোকদের মাধ্যমে এ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে।
অনলাইন জুয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এসব অনলাইন প্ল্যাটফর্মে জুয়ার নানা ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করা ওয়েবসাইট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বিটিআরসিকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বিকাশ, নগদ, রকেট, এমক্যাশসহ মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে যাতে জুয়ার অর্থ পরিশোধ করতে না পারে, সে বিষয়ে নির্দেশনা জারি করতে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এর আগে এ সংক্রান্ত রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে টিভি চ্যানেল ও সব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে জুয়ার বিজ্ঞাপন অপসারণ ও প্রচার বন্ধে ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিল হাইকোর্ট। ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর ওই রুল জারি করা হয়, যা এখনো বিচারাধীন।