Home সারাদেশ নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বপ্ন
জুলাই ১২, ২০২৩

নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বপ্ন

কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বেড়েছে নদ-নদীর পানি। পাশাপাশি বেড়েছে ভাঙন। তলিয়ে গেছে হাজারো মানুষের স্বপ্ন। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর ও শাহজাদপুর এবং কুড়িগ্রামের রৌমারীতে বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি, ফসলি জমিসহ সরকারি-বেসরকারি নানা স্থাপনা। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নদী পারের মানুষ। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে কেউ কেউ অন্যত্র আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ আবার নদী পারে ছাপড়া উঠিয়ে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের পাশে এখনো দাঁড়াননি সরকারি অথবা বেসরকারি কোনো কর্মকর্তা কিংবা জনপ্রতিনিধি। ফলে পরিবারগুলো খেয়ে না-খেয়ে দিনাতিপাত করছেন।  সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর ইউনিয়নের চর জগনাথপুর গ্রাম গত তিন বছরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। উপজেলার নিশ্চিন্তপুর, কাজলগাঁও ও ডিক্রীদোরতা গ্রামে ভাঙনের করাল গ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ৩ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। স্থানীয়রা বলছেন ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে প্রতিদিনই মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ছে। জগনাথপুর গ্রামে তোজ্জামেল হক বলেন, এ গ্রামে ১ হাজার ৩০০ ভোটার ছিল। এখন আর গ্রামের কোনো চিহ্ন নেই। সাক্ষী হিসেবে কয়েকটি গাছ ও সামান্য একটু ভূমি থাকলেও নেই কোনো বসতি।

ডিক্রীদোরতা গ্রামের কোরবান আলী বলেন, আমাদের বসতবাড়ি নদীর ১০০ মিটার দূরে। যে কোন সময় আমাদের ঘরবাড়ি যমুনার গর্ভে চলে যেতে পারে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জিত কুমার সরকার বলেন, ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এমপি তানভীর শাকিল জয় বলেন, আপাতত ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে তিনটি পয়েন্টে জিও ব্যাগ ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে উজানের ঢলে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০টি বাড়িঘর ও বেশকিছু গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাড়িঘর হারিয়ে অসহায় মানুষজন খোলা আকাশের নিচে বাস করছে।

এ ভাঙ্গনের জন্য নির্মাণাধীন তীর সংরক্ষণ বাঁধের ঠিকাদারের গাফিলতির অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। শাহজাদপুরের ব্রহ্মণগ্রাম থেকে পাঁচিল পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজ চলমান থাকলেও ভাঙন রোধ না হওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। জানা যায়, প্রায় দেড় বছর আগে ৬৪৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে এ বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সঠিক সময়ে কাজ না করায় ভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, ভাঙন কবলিত এলাকায় বস্তা ফেলার কাজ চলছে। আশাকরি অচিরেই এ ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে।

কয়েকদিন থেকে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তীব্র স্রোতে কুড়িগ্রামের রৌমারীর বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। চরশৌলমারী ইউনিয়নের ঘুঘুমারী গ্রামের প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় গত এক সপ্তাহে ২০ থেকে ২৫টি বসতবাড়িসহ কৃষিজমি নদের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে নিঃস্ব হয়েছে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫টি পরিবার। ওই পরিবারগুলো বর্তমানে তারা নদের পাড়ে পাটখড়ি দিয়ে ছাপড়া উঠিয়ে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে এখনো দাঁড়াননি সরকারি অথবা বেসরকারি কোনো কর্মকর্তা কিংবা জনপ্রতিনিধি। ফলে পরিবারগুলো খেয়ে না-খেয়ে দিনাতিপাত করছেন।

সরেজমিনে মঙ্গলবার চরশৌলমারী ইউনিয়নের ঘুঘুমারী গ্রাম ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। একইভাবে রৌমারীর শেখের বাজার, খেদাইমারী, চর খেদাইমারী, ফলুয়ার চর, পালেরচর, কান্দাপাড়া, দিঘলাপাড়া ও ধনারচর পশ্চিমপাড়া গ্রামে বসতবাড়ি ও কৃষিজমি নদের গর্ভে বিলীন হচ্ছে। ফলে নতুন করে ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। ঘুঘুমারী গ্রামের জবেদ আলী বলেন, কয়েকদিনের মাথায় আমার বাড়িটি নদে ভেঙে যায়। কৃষিজমি যা ছিল, সব নদে গেছে। আমি সহায়সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। এর আগেও নদে তিনবার বাড়ি ভেঙে গেছে। আমরা রিলিফ চাই না, সরকার যদি নদী ভাঙনরোধ করে দেয়, তাহলে কোনোমতে বাঁচতে পারব।

চর গেন্দারআলগা গ্রামের সকিনা খাতুন বলেন, ‘আমার ঘরবাড়ি ও গাছপালা সব নদে ভেঙে গেছে। নিজের জায়গা না থাকায় নদের পাশেই ছাপড়া তোলে কোনো রকম ঠাঁই করে আছি। সরকারের কাছে দাবি, নদে যেন বানদি দেয়।’ ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দুই মাস আগে পানিসম্পদমন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নদীভাঙন এলাকা দেখে গেছেন। কিন্ত এখন পর্যন্ত কার্যকরি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ইতোমধ্যে অনেক পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে পথে বসেছেন। পুনর্বাসন করা না হলে তারা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে খুব বিপদে পড়বেন।

চরশৌলমারী ইউপি চেয়ারম্যান একেএইচএম সাইদুর রহমান দুলাল বলেন, প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় নদের ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এখনই নদের ভাঙন রোধ করা না হলে ঘুঘুমারী গ্রামটি সম্পন্ন নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। অনেক পরিবার তাদের ঘরবাড়ি নদে বিলীন হওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ওই পরিবারগুলো আত্মীয়স্বজন ও নদের পাশেই খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। তাদের পুনর্বাসন করা জরুরি। ইউপি থেকে কিছু অর্থ দিয়ে ও গ্রামবাসীর সহযোগিতায় আপাতত বাঁশের বান্ডাল দিয়ে ভাঙনরোধ করার চেষ্টা করা হবে।

স্থানীয় প্রশাসনের কাছে ভাঙন এলাকা সুনজরে রাখার অনুরোধ করনে তিনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদ হাসন খান জানান, জরুরি ভিত্তিতে খোজখবর নিচ্ছি এবং ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামন বলেন, বিষয়টি জেনেছি। ভাঙন এলাকায় লোক পাঠানো হচ্ছে পরিদর্শনের জন্য। সেখানে কী ব্যবস্থা নিলে নদের ভাঙন রোধ করা যাবে, আমরা সেটাই করব। আর অন্য এলাকায় নদের ভাঙন রোধে কাজ চলমান রয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *