গরিবের তরকারি আলুর দাম বাড়ল তিন দফা
চলতি বছর দেশে রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদিত হয়েছে। বিদেশে উল্লেখযোগ্য কোনো রপ্তানিও হয়নি। তারপরও আলুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এক মাসে তিন দফায় বেড়েছে ‘গরিবের তরকারি’ খ্যাত এই পণ্যটির দাম। আলুর দাম কেন বাড়ছে, এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছে। বিএডিসি বলছে, উৎপাদন কম হয়েছে। তাই দাম বেড়েছে। আবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, এবার রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদিত হয়েছে। আলুর কোনো অভাব নেই। ঈদের কারণে ট্রাক কম থাকায় গুদাম থেকে বাজারে সরবরাহ করতে না পারায় আলুর দাম বেড়েছে। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন সূত্র জানায়, দেশে কোনো পণ্যের অভাব নেই। লাখ লাখ টন আলু গুদামে পড়ে আছে। সিন্ডিকেট করে আলুর বাজার অস্থির করা হচ্ছে। শুধু আলুর দাম বাড়িয়ে ১০ দিনে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এ ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। দেশে কাঁচামরিচও পর্যাপ্ত রয়েছে। কিন্তু বাজার অস্থির করে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে। এছাড়া ভারতের মরিচ দেশে আমদানির একটা অজুহাত খোঁজা হচ্ছিল। এই সুযোগে ভারত থেকে মরিচ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর দেশে আলু উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১১ লাখ মেট্রিক টন। দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৭০ থেকে ৭৫ লাখ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত থাকছে প্রায় ৩৭ লাখ মেট্রিক টন। সেক্ষেত্রে দাম বাড়ার কোনো সুযোগই নেই। তারপরও আলুর দাম কেজিপ্রতি স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আলুর এই উচ্চমূল্য নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে ব্যয় হয় ৮ থেকে ১০ টাকা। বর্তমানে কৃষকের কাছে কোনো আলু নেই। সব আলু কোল্ড স্টোরেজে। ব্যবসায়ীরা কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণ করেন। এখন তারা বাড়তি দামে আলু বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। এর কানাকড়িও পায় না কৃষক। ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে আলুর দাম বাড়িয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। গুদাম পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রথম ধাপে আলুর দাম ২৫ টাকা থেকে হঠাৎ ১০ টাকা বাড়িয়ে ৩৫ টাকা হয়। পরবর্তী ধাপে ১০ টাকা বেড়ে ৪৫ এবং সর্বশেষ ধাপে ৫৫ টাকা করে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবির হিসাবে, গত বছর এ সময় প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ২৮ থেকে ৩০ টাকা। অথচ এ বছর প্রতি কেজি আলুর দাম ৫৫ টাকা। এ বিষয়ে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের সদস্য মো. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এ বছর আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। যে কারণে আলুর দাম বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, আমি জানি, আলুর কেজি ৪০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে, ৫০ থেকে ৫৫ টাকা হয়েছে, এটা আমার জানা নেই।
চলতি বছর কোনো দেশে আলু রপ্তানি হয়েছে কি না জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গতবারের তুলনায় এ বছর রপ্তানি কম হয়েছে। রাশিয়া ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন নেওয়ার চুক্তি করেও শেষ পর্যন্ত নেয়নি। সামান্য কিছু আলু প্রতিবছর রপ্তানি হয়। এবারও তাই হয়েছে। তিনি জানান, প্রতিবছর কোল্ড স্টোরেজের আলু বিক্রির জন্য নামানো হয় জুন-জুলাইয়ে। এবার কোল্ড স্টোরেজের আলু নামানো হয়েছে এফ্রিল-মে মাসে। প্রায় দুই মাস আগে গুদামজাত আলু বাজারে বিক্রির জন্য বের করা হয়েছে। কারণ, আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। তিনি আরও জানান, বিএডিসির গুদামে প্রায় ৩৭ হাজার মেট্রিক টন আলু বীজ হিসাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
তাহলে উৎপাদিত এত আলু গেল কোথায়-এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বিষয়টি ভালো বলতে পারবে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. মজিবর রহমান যুগান্তরকে বলেন, চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ১১ লাখ মেট্রিক টন। তবে বর্তমানে আলুর বাজার দর একটু অস্বাভাবিক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জেলায় জেলায় কৃষি বিপণন কর্মকর্তাদের বাজার তদারকি করতে বলা হয়েছে। তারা কাজ করছে। দুই-চার দিনের মধ্যে আলুর দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তিনি আরও জানান, এখনো কোল্ড স্টোরেজে প্রায় ২৮ লাখ মেট্রিক টন আলু রয়েছে, যা দিয়ে জানুয়ারি পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। তিনি আরও জানান, শনিবার সকালে খিলগাঁও বাজারে তিনি ৫০ টাকা করে আলু বিক্রি হতে দেখেছেন। তবে ৫৫ টাকা হয়েছে তা তিনি জানেন না। এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মজিবর রহমান বলেন, ঈদের কারণে ট্রাক পাওয়া যাচ্ছে না। দুই-তিন দিনের মধ্যে ট্রাক পাওয়া সহজ হবে। তখন আলুর সরবরাহ বাড়লে দাম কমে যাবে। সিন্ডিকেট সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা নেই। বাজার স্বাভাবিক করতে আমরা কাজ করছি।