শ্রেণি জাল করে জমি রেজিস্ট্রি অব্যাহত
জমি রেজিস্ট্রেশনে দুই ধরনের জালজালিয়াতি অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। প্রথমত, খতিয়ান টেম্পারিং করে জমির উচ্চমূল্যের শ্রেণিকে নিুমূল্যের শ্রেণি দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করা। যেমন: ভিটি শ্রেণির জমিকে নাল দেখিয়ে অহরহ রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, উদাহরণস্বরূপ যে জমির মূল্য দুই কোটি টাকা দেখিয়ে সাফ কবলা দলিল করা হচ্ছে, তা আবার পরক্ষণেই একই সাবরেজিস্ট্রার ২২ কোটি টাকা মূল্য ধরে ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ দলিল করে দিচ্ছেন। এতে লাভবান হচ্ছেন ক্রেতা ও সাবরেজিস্ট্রার।
ক্রেতাকে মোটা অঙ্কের ব্যাংক ড্রাফট দিতে হচ্ছে না। এক কোটি সাশ্রয় হলে সাবরেজিস্ট্রারকে ৩০ লাখ ঘুস দিতেও দলিল গ্রহীতার কোনো ওজর আপত্তি থাকছে না। মূলত এভাবে ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতি জেঁকে বসেছে রেজিস্ট্রিশন সেক্টরে।
এ বিষয়ে যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে চাক্ষুষ প্রমাণও মিলেছে। যার সঙ্গে জড়িত সাবরেজিস্ট্রার মিনতী দাস। তিনি রাজধানীর পল্লবী সাবরেজিস্ট্রি অফিসে থাকা অবস্থায় ভিটি শ্রেণির জমিকে নাল দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করেন।
গাজীপুর সদরে থাকাবস্থায় সকালে একটি জমি প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্য দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করেন, এক ঘণ্টা পর পরবর্তী দলিলে ২২ কোটি টাকা মূল্য দেখিয়ে ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ দলিল করে দেন। এভাবে তিনি দলিলদাতাকে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
সূত্র বলছে, ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতার সঙ্গে যোগসাজশে যুক্ত হয়ে মিনতী দাসের মতো একশ্রেণির দুর্নীতিপরায়ণ সাবরেজিস্ট্রার অবাস্তব এলসি ডিক্লারেশনকে আমলে নিয়ে এভাবে জমি রেজিস্ট্রি করছে। এর ফলে সরকার প্রাপ্য বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। রক্ষকরা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় সরকারের স্বার্থ দেখার কেউ নেই। তবে সাবরেজিস্ট্রারদের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত নন।
সুনাম অর্জনকারী পেশাদার অনেক সাবরেজিস্ট্রারও আছেন। অথচ কিছুসংখ্যক অসৎ সাবরেজিস্ট্রারের কারণে সবার ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
কেস স্টাডি-১: ঢাকার পল্লবী সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট ৪৯৬১নং সাফ কবলা দলিল রেজিস্ট্রির সময় শ্রেণি পরিবর্তন করে সরকারের ৫৩ লাখ ১১ হাজার ১৪৮ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়। ওই সময় সেখানে সাবরেজিস্ট্রার ছিলেন মিনতী দাস।
এই জমির নামজারি ও খতিয়ান অনুযায়ী এর শ্রেণি ভিটি। কিন্তু নাল দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়। তফশিল অনুযায়ী জমির অবস্থান জোয়ার সাহারা মৌজায়। ঢাকা সিটি জরিপ অনুযায়ী ২০৪০০ ও ২০৪০২ দাগের ১৪.৮২ শতক জমি বিক্রি করা হয়।
এখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, সব ধরনের ইউটিলিটি সুবিধাসহ জমিটি ভিটি শ্রেণির। খতিয়ানের দখলবিষয়ক ও অন্যান্য বিশেষ মন্তব্য সংক্রান্ত ৯নং কলামে স্পষ্টভাবে বলা আছে জমিতে টিনের ঘর আছে। খতিয়ানে অকৃষি প্রজা হোসনে আরা বেগম। যার স্থায়ী ঠিকানা পটুয়াখালীর গলাচিপার রাঙ্গাবালী গ্রাম।
দলিলে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি ১২ লাখ ৬২ হাজার টাকা। অথচ জমি রেজিস্ট্রির সময় ২০১৯ সালে আলোচ্য জমির বাস্তব বাজার মূল্য ছিল কমপক্ষে ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, পল্লবী সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দায়িত্ব পালনকালে তিনি হরহামেশা এভাবে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন দালিল গ্রহীতাদের। এজন্য বিনিময়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকার ঘুস।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, উল্লিখিত জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে দলিলদাতাকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের ঘুস লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। মিনতী দাস দায়িত্ব পালনের সময় যত জমি রেজিস্ট্রি হয়েছে, অডিট করলে ৬০ ভাগ দলিলে এ ধরনের জালজালিয়াতির ঘটনা প্রমাণিত হবে।
পল্লবী অফিসে দায়িত্ব পালনকালে সাবরেজিস্ট্রার মিনতী দাসের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন উমেদার মো. জসিম। এই উমেদারও কম যান না। তিনি এখনো পল্লবী সাবরেজিস্ট্রি অফিসে কর্মরত। অভিযোগ রয়েছে, সুচতুর জসিম এভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির সহযোগী হয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনিসহ রেজিস্ট্রি ভবনের বেশির ভাগ উমেদারের অর্থসম্পদ নিয়ে তদন্ত হলে দুর্নীতি দমন কমিশন জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের সন্ধান পাবে। এদের অনেকের ট্যাক্স ফাইলের সঙ্গে বাস্তবে থাকা অর্থসম্পদের মিল নেই।
কেস্টাডি-২: গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার কাসিমপুর থানাধীন সুরাবাড়ী মৌজায় ৩৬ শতাংশ জমির মালিক মন্ডল নিট ওয়্যারস লিমিটেড কর্তৃপক্ষ।
সাফ কবলা ১৭৫১নং দলিলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি জমিটি ক্রয় করে ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। সিএস ও এসএ ৩নং খতিয়ানে যার দাগ নং ২৪। মিরপুর থানার ১১নং এডি-২ নং বি ব্লক এর বাসিন্দা মরহুম আফজাল হোসেনের স্ত্রী আরিফা হোসেনের সঙ্গে ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর ডিড অব এক্সচেঞ্জ দলিল করে মন্ডল নিট ওয়্যারস লিমিটেড। এভাবে মালিকানা অর্জন করেন আরিফা হোসেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি ওই জমিতে চারতলা ভবন নির্মাণ করেন। প্রতি ফ্লোরে ১৫ হাজার স্কয়ার ফুট হিসাবে ৬০ হাজার বর্গফুটের ভবনটিতে সব ধরনের ইউটিলিটি সেবা গ্রহণ করে ভবনটিতে পোশাক শিল্প কারখানা করা হয়।
ভবনসহ জমিটি ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল মাত্র ১ কোটি ৯৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দাম ধরে নূর নিট (বিডি) নামক একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়। ডিডে স্বাক্ষর করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার মঞ্জুর মোর্শেদ। এই দামে জমিটি ৫৩১৬নং সাফ কবলা দলিলমূলে রেজিস্ট্রি করে দেন গাজীপুর সদরের তৎকালীন ২য় যুগ্ম সাবরেজিস্ট্রার মিনতী দাস। অথচ জমিটির বাস্তব দাম কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা। এখানে প্রকৃত দরের সঙ্গে পার্থক্য ২৮ কোটি ৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা।
এভাবে প্রকৃত দর গোপন করে জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়ায় সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি ৫৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৪৯ টাকা। এর মধ্যে ৫৩ এফএফ ১ কোটি ৯৫ লাখ ১৬ হাজার ৭২৯, ভ্যাট ১ কোটি ৩৫ লাখ, স্ট্যাম্প ৪৫ লাখ, রেজিস্ট্রি ফি ৩০ লাখ, স্থানীয় কর ৬০ লাখ এবং গেইন ট্যাক্স ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
এদিকে এই জমি একই দিন পরবর্তী সিরিয়ালে ৫৩১৭নং বন্দকনামা দলিল দ্বারা ২২ কোটি ৫৯ লাখ ৬২ হাজার টাকায় ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা হয়। অভিযোগ আছে, এহেন অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাবরেজিস্ট্রার মিনতী দাস মোটা অঙ্কের উৎকোচ নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। কেননা একই দিনে যে জমির মূল্য সকালে দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৯৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, তা দুপুরে কীভাবে অপর একটি দলিলে ২২ কোটি টাকা দেখিয়ে ব্যাংকের কাছে বন্দক রাখা হলো।
এই কারচুপির বিষয়টি সাবরেজিস্ট্রার তার জ্ঞাতসারেই করেছেন। এর ফলে তিনি এক পক্ষকে লাভবান করে নিজে সুবিধা নিয়েছেন। বিপরীতে সরকারকে ন্যায্য প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছেন।
পল্লবী সাবরেজিস্ট্রি অফিসের জমির শ্রেণি জালিয়াতির বিষয়ে মিনতী দাসের সঙ্গে গত বছর সেপ্টেম্বরে যোগাযোগ করা হয়। সেসময় তিনি গাজীপুরে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ব্যস্ততা দেখিয়ে কথা বলতে চাননি। এরপর তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা না করে রিপোর্ট বন্ধ করতে নানামুখী তদবির শুরু করেন।
শনিবার সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। তাকে পরিচয় দিয়ে খুদে বার্তাও দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি রেসপন্স করেননি।
মিনতী দাসের বর্তমান কর্মস্থল কিশোরগঞ্জ সদর। মাত্র ১২ বছরের চাকরিজীবনে ১১ কর্মস্থলে কাজ করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বেশুমার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে মোড়ানো তার চাকরিজীবন। ভাবখানা এমন-তিনি পরোয়ানো করেন না কাউকে। আছেন বেশ বহাল তবিয়তে। এত অনিয়ম-দুর্নীতি করলেও কিছুই হয়নি তার।
প্রসঙ্গত, মিনতী দাসের জন্ম ১৯৬৬ সালের ১৪ মার্চ। এ হিসাবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। অথচ তিনি মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী তথা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সাবরেজিস্ট্রার পদে চাকরি পান। উচ্চ আদালতের রায়ে ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর সাবরেজিস্ট্রার পদে আত্তীকৃত হন।
এর আগে তিনি বরিশালে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ পদে কর্মরত ছিলেন। তার স্বামী পরিতোষ কুমার দাসও মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসাবে সাবরেজিস্ট্রার পদে আত্তীকৃত হন ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। কক্সবাজারের চকরিয়ায় কর্মরত থাকাবস্থায় সনদ জালিয়াতির মামলায় তিনি দুদকের হাতে গ্রেফতার হয়ে কিছুদিন জেলও খাটেন।
ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার অহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট ম্যানুয়ালের ১৩৭ ধারা অনুযায়ী রেকর্ড অব রাইটস (আরওআর)-এর কপি সংশ্লিষ্ট সাবরেজিস্ট্রারদের সরবরাহ করার বিধান রয়েছে। কিন্তু সেটেলমেন্ট অফিস থেকে তাদের দেওয়া হয় না।
এ কারণে জমি রেজিস্ট্রি করার সময় জমির প্রকৃত শ্রেণি যাচাই করা সম্ভব হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এ সংক্রান্ত কোনো অ্যাপ আমরা পাইনি।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ডিসি) মোহাম্মদ মমিনুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলায় জমির খতিয়ানসহ শ্রেণি চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য অনলাইনে দেওয়া আছে। যে কেউ চাইলে সেটি দেখতে পারে। ফলে আরওআর ছাড়া সাবরেজিস্ট্রাররা জমির শ্রেণি যাচাই করতে পারছেন না- এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য হবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সোর্সে আমরাও শুনছি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভিটি শ্রেণির জমিকে নাল দেখিয়ে কেউ কেউ জমি রেজিস্ট্রি করছেন। এর ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। এজন্য আমরা ডিসি অফিসের দলিল অবমূল্যায়ন শাখার কার্যক্রম জোরদার করেছি। সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য পেলে মামলা দায়েরসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অডিট সুপারিশও উপেক্ষিত : সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করার বিষয়ে ২০০৫ সালে আইন মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন বই আকারে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে কেস স্টাডি হিসাবে গুলশান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও হবিগঞ্জ সদর অফিসের ওপর প্রতিবেদন দেওয়া হয়। বিশদ রিপোর্টের শেষদিকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়।
উল্লেখযোগ্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে-দলিল রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে জমি/সম্পত্তির শ্রেণি যাচাইপূর্বক রেজিস্ট্রি করা আবশ্যক। রেজিস্ট্রি দলিলে ব্যাংক ঋণের জন্য দলিলে প্রদর্শিত মূল্য এবং ওই সম্পত্তির ক্রয়মূল্য একই হতে হবে। কেননা, সাবরেজিস্ট্রার দুই ধরনের মূল্য দেখানোর কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।