সংকটেও মূল্যস্ফীতির উত্তাপ কমানোর স্বপ্ন
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, সারসহ নিত্যপণ্যের মূল্য শিগগিরই কমবে-এমন আভাস মিলছে না। সম্প্রতি কিছুটা দাম কমলেও এর কোনো প্রভাব দেশের বাজারে পড়েনি। অপরদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরও কতদূর গড়াবে এই মুহূর্তে বলা কঠিন। যদি এ যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রভাবে দেশের মূল্যস্ফীতি এবং অস্থিতিশীল করে তুলছে মুদ্রা বিনিময় হার। ফলে ডলারসহ নানা সংকটে ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্যেও মূল্যস্ফীতির উত্তাপ কমতে পারে আগামী অর্থবছর-এমন পূর্বাভাস দিয়েছে অর্থ বিভাগ। এছাড়া স্থিতিশীল হবে মুদ্রা বিনিময় হার, বাড়বে বিনিয়োগ এবং বিশ্ববাজারে কমে আসবে জ্বালানি তেল, সার ও গ্যাসের মূল্য। এ যুদ্ধ চরম সংঘাতপূর্ণ অবস্থায় রূপ নেবে না বলেও পূর্বাভাসসংক্রান্ত প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। কিন্তু বর্তমান ডলার সংকট, রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি, অস্থিতিশীল মুদ্রা বিনিময় হার বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করছে অর্থনীতিতে। এর সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মূল্যস্ফীতির হার এবং বিনিয়োগে বিরাজ করছে মন্দাভাব। বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। এমন পরিস্থিতিতে অর্থ বিভাগের মধ্য মেয়াদের এই পূর্বাভাস কতটা বাস্তবসম্মত-এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরি যুগান্তরকে জানান, আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতি ও মুদ্রা বিনিময় হার নীতির সামঞ্জস্য। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিভিন্ন কারণে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কারণ, এখানে শুধু চাহিদার কারণে নয়, অন্যান্য সূচকেও মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সম্প্রাসরণমূলক রাজস্বনীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির সঙ্গে সামঞ্জ্যপূর্ণ হতে হবে। এটা সম্ভব হচ্ছে না। কাজেই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পারব, সেটি কতটুকু সফল হবে, তা বলা মুশকিল। এছাড়া আগামী দিনগুলোয় মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এতে টাকার মূল্য আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে রাজস্ব ও মুদ্রা বিনিময় হারের যে নীতি নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো মূল্যস্ফীতি সহায়ক নয়।
জানা গেছে, মধ্যমেয়াদি (২০২৩-২০২৬) অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগ একটি পূর্বাভাস প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে বলা হয়, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার লক্ষ্যে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদ হার বাড়িয়েছে। ১০ মের মধ্যে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সুদ এবং সিকিউর্ড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট উভয়ই ৫ শতাংশের ওপরে পৌঁছেছে। অর্থ বিভাগ অনুমান করছে, এই সুদহার ইতোমধ্যে শীর্ষপর্যায়ে চলে গেছে এবং মধ্য মেয়াদে ধীরে ধীরে কমে আসবে।
সেখানে আরও বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরপরই বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। তবে সংশ্লিষ্ট পক্ষের মধ্যে শস্য রপ্তানি চুক্তি এবং সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকায় পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। আর রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেল রপ্তানি অব্যাহত আছে। ধারণা করা হচ্ছে, যুদ্ধের মাত্রা চরম আকারে না পৌঁছালেও তেল, গ্যাস, সার ও শস্যের দাম আর বাড়বে না। বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম কমছে। ফলে দেশীয় বাজারে মূল্যস্ফীতি কমাতে তা সহায়ক হবে।
পূর্বাভাসে বলা হয়, সম্প্রতি বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপের কারণে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে। এটি ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির বড় কারণ। এটি মোকাবিলায় সরকার নীতি-পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে ইতোমধ্যে অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করেছে। ধরে নেওয়া হচ্ছে, মধ্য মেয়াদে মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে এবং মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ববাজারে এই মুহূর্তে অনেক পণ্যের দাম কমছে। কিন্তু এর প্রতিফলন দেশের বাজারে নেই। উলটো ডলারের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে বাড়ছে ভোজ্যতেল, চিনিসহ অন্যান্য পণ্যের দাম। ফলে আগামী মূল্যস্ফীতি কমবে-এমন বলা মুশকিল।
অর্থবছরের (২০২২-২৩) শুরুতে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে ধরে নিয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু এটি ডিসেম্বরের মধ্যে ৯ শতাংশের ওপরে চলে যায়। সর্বশেষ সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। আর প্রস্তাবিত (২০২৩-২৪) অর্থবছরের বাজেট ৬ শতাংশ ঘরে মূল্যস্ফীতি থাকবে বলে প্রত্যাশা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থ বিভাগের পূর্বাভাসে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে তুলে ধরা হয়।
সেখানে উল্লেখ করা হয়, মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির সঙ্গে নিম্ন-আয় থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে অধিকাংশ মানুষ অন্তর্ভুক্ত হবে। এতে অভ্যন্তরীণ ভোগ বাড়বে। এটি জিডিপি বাড়াতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে মোট বিনিয়োগও বাড়বে। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিনিয়োগ বাড়াতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেখানে দুর্বল অবস্থান রয়েছে। ফলে কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে সেখানে বলা হয়, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা সন্তোষজনক। প্রতিবছর টেকসই ঘাটতি নিশ্চিত করেই বাজেট প্রণয়ন করা হয়। ফলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, মধ্য মেয়াদে কোনো ঋণ সংকট হবে না।