Home সারাদেশ ৪০০ টাকা হতে পারে পোলট্রি মুরগি
জুন ৭, ২০২৩

৪০০ টাকা হতে পারে পোলট্রি মুরগি

অনলাইন ডেস্ক,

ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে দেশের পোলট্রি খাতের সংকট। করপোরেট ও প্রান্তিক খামারিদের অসম প্রতিযোগিতা বিস্তার লাভ করেছে খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে। বিশেষ করে প্রতিদিনের বাজারদর যা ঘরে বসেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অনলাইনে। এছাড়া নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে প্রান্তিক খামারিদের বাইরে রাখা, ফিডের দামের ক্ষেত্রে দুই-নীতি এবং সমস্যা সমাধানে ধীরগতি পরিস্থিতি আরও জটিল করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত এক বছর ধরে বহুমুখী সংকটে বিপর্যন্ত এই খাত। তবে এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে জানুয়ারি থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে ভোক্তার ব্যয়। দীর্ঘদিন এমনকি রমজানেও স্বাভাবিক করা যায়নি বাজারদর। আর এই নিয়ন্ত্রণহীনতার সুযোগ নিয়ে অসাধু একটি চক্র উৎপাদন থেকে শুরু করে পুরো বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ খামারিদের।

বিভিন্ন সূত্রের তথ্যানুযায়ী পোলট্রি পণ্য ডিম ও মুরগির প্রতিদিনের বাজারদর নির্ধারণে এখন আর খামারি কিংবা পাইকারি পর্যায়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের কোনো হাত নেই। তথাকথিত সিন্ডিকেটের সদস্যরা ঘরে বসেই অনলাইনে ফেসবুক পেজ, ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ, ওয়েবসাইট, স্থানীয় নিউজ কিংবা বাণিজ্যিক পোর্টালে দাম নির্ধারণ করে দেয়। এসব গ্রুপ বা পোর্টাল চালানো হয় পোলট্রি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নামে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব সংগঠনের বেশিরভাগই কর্পোরেট ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত। এমনকি প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন দাবি করেও অনেক গ্রুপ অনলাইনে এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রান্তিক খামারিদের প্রতিনিধিত্ব করে এমন ব্যক্তিরা জানান, গোটা দেশের প্রতিদিনের ডিম ও মুরগির পাইকারি দর কত হবে তা এসব গ্রুপ বা ওয়েবসাইটই নির্ধারণ করে দেয়। ফলে খামারিরা সে দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হন। এছাড়াও দেশব্যাপী বাজারমূল্য ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় মহাজনরা এই চার্টের দামের বাইরে যেতে পারেন না।

ফলে বেশিরভাগ সময় মাংস ও ডিমের উৎপাদন খরচের অনুপাতে দাম পান না বলে জানিয়েছেন খামারিরা। দেশের বাজারে এক দিনের বাচ্চা ও ফিডের বাজার শতভাগ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের দখলে থাকলেও মাংস ও ডিমের ৮০ ভাগ উৎপাদন করে থাকে এই প্রান্তিক খামারিরা। তাদের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে উৎপাদন খরচ বাড়লেও দাম বেশি থাকায় কিছুটা লাভ রয়েছে। কিন্তু সবসময় একই পরিস্থিতি থাকে না। তাদের অভিযোগ বাচ্চার দাম বেশি থাকায় লাভ সীমিত তবে এসব খামারিরা যদি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে ১ দিনের বাচ্চা নেওয়া কমিয়ে নিজেরা উৎপাদন করতে যায় তখনই তাদের বাচ্চার দাম কমিয়ে ও নিয়ন্ত্রিত চুক্তিভিত্তিক খামারিদের দিয়ে বাজারে মাংস ও ডিমের দাম কমিয়ে দেন। ফলে বাড়তি খরচ করে প্রান্তিক খামারিরা লোকসানে পরে। এছাড়াও প্রতিদিনের বাজারদর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় পণ্যের মূল্যের পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কিছু করার থাকে না।

এদিকে, পোলট্রি খাতের সংগঠনগুলো সরাসরি এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এসব সংগঠনের প্রায় সবাই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সদস্য। ফলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে খামারিদের অংশগ্রহণ থাকে না। প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার যায়যায়দিনকে বলেন, যারা এই খাতে বিভিন্ন কর্পোরেট সংগঠনের সঙ্গে জড়িত তারাই আবার প্রান্তিক খামারিদের রক্ষার নামে নতুন সংগঠন করে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে।

দেশে বর্তমানে প্রায় ৭ থেকে ৮টি সংগঠন রয়েছে যার ৯০ শতাংশ কর্পোরেট উৎপাদনকারীদের। এসব সংগঠনের ৭ জন সভাপতি ও ৭ জন সেক্রেটারি রয়েছেন যাদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেন্ট্রাল কাউন্সিল। আর এই সংগঠন দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় গোটা পোলট্রি খাত। এছাড়াও এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বর্তমান ও সাবেক ডিজি।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমস্যা জানা থাকলেও পুঁজির দাপট ও সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠীর নিত্যনতুন কৌশলের কাছে কেবল সাধারণ ভোক্তারাই জিম্মি নন, পুঁজি হারিয়ে পথেও বসেছেন হাজার হাজার প্রান্তিক খামারি। বিশেষভাবে টার্গেট করে ফিডসহ উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে দাম ওঠানামা ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ থাকায় সংকট সমাধানে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন তারা।

সিন্ডিকেটে বাজারদর যেমন নিয়ন্ত্রণ করা হয় একইভাবে ফিডের ক্ষেত্রে দুই নীতি এই খাতের সংকটের অন্যতম কারণ। এছাড়াও আমদানি মূল্যের থেকে ফিডের দাম বেশি থাকায় বাজারে মুরগির দাম কমলে লোকসানের পরে এই প্রান্তিক খামারিরাই। এমন উভয় সংকটের মধ্যে প্রান্তিক খামারিরা ফিড কিনে থাকেন বেশি দামে।

জানা গেছে, প্রতি ১ হাজার মুরগির জন্য ৩০-৩২ দিনে ৫০ কেজি ওজনের ৪৫-৪৬ বস্তা খাদ্য লাগে। এ সময় প্রতি মুরগির ওজন হয় ১৬০০-১৭০০ গ্রাম। তাদের দেওয়া হিসাবে, প্রতি দেড় কেজি মুরগি উৎপাদনে ২.২৫ কেজি খাবার প্রয়োজন হয়। সে হিসেবে প্রতি কেজি মাংস উৎপাদনে দেড় কেজি খাবার প্রয়োজন হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় মুরগির বাচ্চার দাম। যা এখন ৬০ টাকার উপরে। এর বিপরীতে কর্পোরেট উৎপাদনে প্রতি কেজি খাদ্যে প্রায় ২০-২৫ টাকা পর্যন্ত কম খরচ হয়। কারণ তারা নিজেরাই খাদ্য উৎপাদন করে। এর বাইরেও এসব প্রতিষ্ঠানের অধীনে চুক্তিভিত্তিক খামারিরা একই দামে খাদ্য কেনেন। ফলে বাজারে ২০০ টাকা ব্রয়লার বিক্রি হলে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের লাভ থাকলেও প্রান্তিক খামারি লোকসানে পরে। তাই দেশে পোলট্রি শিল্প রক্ষায় ফিড ও মাংসের বাজারে যৌক্তিক দাম নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন খামারিরা। তবে অভিযোগ রয়েছে খামারিদের দাবির প্রেক্ষিতে পোলট্রি বোর্ড গঠন করা হলেও সত্যিকারের খামারিদের অংশগ্রহণ নেই। ফলে সরকারের সঙ্গে যারা আলোচনা করছেন তারা প্রান্তিক খামারিদের স্বার্থ দেখছেন না বলেও জানান তারা।

দেখা গেছে. গত এক বছর ধরে খুচরা বাজারে যে হারে মুরগির দাম বেড়েছে একই হারে বেড়েছে ফিডের দাম। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও ভুট্টার দাম ব্যাপক হ্রাস পেলেও দেশের বাজারে তা আরও বেড়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্যানুযায়ী রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ২০২১ সালে ভুট্টার ক্রয়মূল্য প্রতি কেজি ২৮ টাকা এবং সে সময়ে দেশের বাজারে ফিড আকারে ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হতো ২ হাজার ৫০০ টাকায়। অর্থাৎ ১ হাজার ৪০০ টাকার কাঁচামালে উৎপাদিত ফিডে আয় হতো ১ হাজার ১০০ টাকা। তবে যুদ্ধের পর ৩৮ টাকা হয় প্রতি কেজি কাঁচামালের দাম। ফলে দেশে তা বেড়ে প্রতি বস্তা বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৭০০ (৫০ কেজি) টাকা দরে। এরপর চলতি বছরে দাম কমে আবার প্রতি কেজি ২৮ টাকা হলেও বাজারে ফিড বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি অর্থাৎ ৩ হাজার ৭৩৭ টাকা দরে। যদিও ২০১০ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে প্রধান করে একটা মূল্য নির্ধারণ কমিটি করা হয়েছে। খামারিরা দাবি করেন, এই কমিটিকে আবার সক্রিয় করা হোক। যারা উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়ে মাসে অন্তত দু-বার ফিড ও মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেবে। এছাড়াও প্রতিদিনের বাজারদর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অথবা নির্ধারিত একটি ওয়েবসাইটে দেওয়ার দাবিও করেছেন তারা, নইলে এ বছরই ৪০০ টাকা কেজি দরে মুরগি খেতে হবে বলেও জানান তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *