Home ধর্মীয় সংবাদ হজ পালন করবেন কীভাবে
মে ২৭, ২০২৩

হজ পালন করবেন কীভাবে

কালো গেলাপ আর সবুজ গম্বুজের দেশে যেতে কার বা মন না চায়। কাবার ছায়ায় আর রওজা পাকের পরশ পেতে মুমিনের অন্তর জীবনভর থাকে প্রতীক্ষায়। কতই না সৌভাগ্যবান তারা যারা আল্লাহর মেহমান হয়ে তার ঘরে যায়। এ বছর প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার ২২১ বাংলাদেশির পবিত্র হজে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। মরহুম আলহাজ শেখ গোলাম মুহীউদ্দীন (রহ.) রচিত ‘কিতাবুল হজ’ অবলম্বনে হজ পালনের সহজ পদ্ধতি তুলে ধরেছেন-মাওলানা তোফায়েল গাজালি

তালবিয়া

‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা, লাকা ওয়াল্ মুলক, লা-শারিকা লাক।’ অর্থ : আমি হাজির, হে আল্লাহ্! আমি হাজির, আমি হাজির, কোনো শরিক নেই তোমার, আমি হাজির, নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই, আর সব সাম্রাজ্যও তোমার, কোনো শরিক নেই তোমার।

যা সঙ্গে নেবেন

দুই সেট ইহরামের কাপড় সঙ্গে নিন। নরমাল স্যান্ডেল নিন (ইহরাম অবস্থায় পরার জন্য)। কাঁধে ঝুলিয়ে রাখার ব্যাগ। লুঙ্গি, পায়জামা, পাঞ্জাবি প্রয়োজন মতো। গেঞ্জি, টুপি, রুমাল ও জুতা প্রয়োজন মতো। গামছা বা তোয়ালে ও ফোল্ডিং ছাতা। টুথপেস্ট, ব্রাস, মিসওয়াক, নোট বই ও কলম। মহিলাদের আবশ্যকীয় জিনিসপত্র। জরুরি প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র। লাগেজ বা সুটকেস।

ইহরাম

যারা প্রথমে মক্কায় যাওয়ার উদ্দেশে রওনা করছেন-তারা বিমানে ওঠার আগেই ইহরাম বেঁধে নিন। কারণ বিমান মিকাত (ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত স্থান) কখন অতিক্রম করবে হয়তো আপনি বুঝতেও পারবেন না। তবে যারা প্রথমে মদিনায় যাওয়ার ইচ্ছা করেন, তারা ইহরাম ছাড়া রওনা হবেন এবং জেদ্দা পৌঁছে সরাসরি মদিনা চলে যাবেন। মদিনা থেকে মক্কায় আসার পথে ইহরাম বেঁধে আসবেন। মক্কায় এসে ওমরাহ পালন শেষে ৮ জিলহজ হারাম শরিফ থেকে আবার যে ইহরাম করবেন-সেটি হবে আপনার হজের ইহরাম।

পুরুষের ইহরাম

১. ইহরাম বাঁধার আগে গোঁফ, চুল, নখ ইত্যাদি কেটে খুব ভালোভাবে গোসল করে আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করে তৈরি হয়ে থাকা উচিত। ২. ইহরামের আগে গোসল করা সুন্নাত। ওজু করলেও চলবে। ৩. সেলাই করা কাপড় খুলে একটা সাদা চাদর নাভির ওপর থেকে লুঙ্গির মতো পরে নিন। আর একখানা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিন। যেন দুই কাঁধ ও পিঠ ঢাকা থাকে। ৪. নিয়তের সঙ্গে সঙ্গে তিনবার তালবিয়া (লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…) উচ্চস্বরে পড়ুন। যদি কেউ পড়তে না পারেন তবে অন্য কেউ তাকে পড়িয়ে দিন। তারপর দরুদ শরিফ পড়ুন এবং মোনাজাত করুন। ৫. দুই ফিতার স্যান্ডেল ব্যবহার করুন যেন পায়ের ওপরের মাঝখানের উঁচু হাড় এবং গোড়ালি খোলা থাকে।

নারীর ইহরাম

১. নারীদের জন্য ইহরামের কোনো নির্দিষ্ট পোশাক নেই। সেলাইযুক্ত যেসব কাপড় সাধারণত পরিধান করেন সেগুলো পরবেন। যেমন : শাড়ি, সালোয়ার, কামিজ, ম্যাক্সি, বোরকা ইত্যাদি। যে কোনো ধরনের আরামদায়ক জুতাও ব্যবহার করতে পারবেন। ২. ইহরাম বাঁধার আগে গোসল করে নিন। গোসল করতে অসুবিধা থাকলে ওজু করুন। ভালোভাবে চুল আছড়ে নিন।

৩. এ গোসল শুধু পরিচ্ছন্নতার জন্য। এ কারণে ঋতুবতী মহিলা এবং শিশুদের জন্যও তা সুন্নাত। এর পরিবর্তে তায়াম্মুম করা শরিয়তসম্মত নয়। ৪. যদি মাকরুহ ওয়াক্ত না হয়, তবে ইহরামের নিয়তে সাধারণ নফল নামাজের মতো দুরাকাত নফল নামাজ পড়ুন। আর যদি মাকরুহ ওয়াক্ত হয় তবে ওই দুরাকাত নফল নামাজ ছাড়াই ইহরামের নিয়ত করুন। ৫. নিয়তের সঙ্গে সঙ্গে তিনবার তালবিয়া (লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…) নিচুস্বরে পড়ুন। যদি পড়তে না পারেন তবে অন্য কেউ তাকে পড়িয়ে দিন। তারপর দরুদ শরিফ পড়ুন এবং মোনাজাত করুন।

ইহরাম অবস্থায় যা করবেন না

১. সেলাইযুক্ত কাপড় যেমন পাঞ্জাবি, পায়জামা, টুপি, গেঞ্জি, মোজা ইত্যাদি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কিন্তু মহিলারা সেলাইযুক্ত স্বাভাবিক কাপড় পরিধান করবেন। ২. পুরুষের জন্য মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা নিষিদ্ধ, জাগ্রত বা ঘুমন্ত উভয় অবস্থায় খোলা রাখতে হবে। ৩. যে কোনো ধরনের সুগন্ধি, আতর, সুগন্ধি তেল বা সুগন্ধি সাবান ব্যবহার করা নিষিদ্ধ।

৪. ক্ষৌরকার্য করা নিষিদ্ধ। ৫. বন্য পশুপাখি শিকার করা বা কাউকে শিকারে কোনোরূপ সাহায্য-সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ। ৬. এমন জুতা পরিধান করা নিষিদ্ধ যার ফলে পায়ের ওপরের মাঝখানে উঁচু হাড় ঢাকা পড়ে যায় কিন্তু মহিলাদের জন্য নিষিদ্ধ নয়। ৭. স্বামী-স্ত্রী দৈহিক সম্পর্ক, এমনকি ওই সম্পর্কে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা ইত্যাদি নিষিদ্ধ। ৮. ঝগড়া-বিবাদ করা, অশ্লীল কথাবার্তা বলা এমনিতেও নিষিদ্ধ, ইহরামের অবস্থায় আরও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

তাওয়াফ

হজের উদ্দেশে কাবা শরিফের চতুর্দিকে ঘোরাকে তাওয়াফ বলা হয়। তাওয়াফের ওয়াজিবগুলো : ১. তাহারাত অর্থাৎ গোসল ফরজ থাকলে তা করে নেওয়া এবং ওজু না থাকলে ওজু করে নেওয়া (২) শরীর ঢাকা (৩) কোনো কিছুতে আরোহণ না করে তাওয়াফ করা (বৃদ্ধ, অসুস্থ ও রুগ্ণ অক্ষম ব্যক্তির জন্য অবশ্য আরোহণ করে তাওয়াফ করা জায়েজ) (৪) ডান দিক থেকে তাওয়াফ করা (৫) হাতিমসহ (বাইতুল্লাহর উত্তর দিকে বাইতুল্লাহসংলগ্ন অর্ধচক্রাকৃতি দেওয়াল ঘেরা জায়গা) তাওয়াফ করা (৬) সবকটি চক্কর পূর্ণ করা (৭) তাওয়াফের শেষে দুই রাকাত নামাজ পড়া। তাওয়াফের সুন্নাতগুলো :

(১) হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু করা (২) ইজতিবা করা (অর্থাৎ ইহরামের চাদর ডান বগলের নিচ দিয়ে এনে বাম কাঁধে জড়ানো) (৩) হাজরে আসওয়াদে চুমু প্রদান করা বা হাতে ইশারা করে তাতে চুমু দেওয়া (৪) প্রথম তিন চক্করে রমল করা (অর্থাৎ বীরদর্পে হাত দুলিয়ে দ্রুত পায়ে চলা) (৫) বাকি চক্করগুলোতে রমল না করা (৬) সায়ী ও তাওয়াফের মাঝে ইস্তিলাম (হাজরে আসওয়াদে চুমু প্রদান বা হাত কিংবা ছড়ি দিয়ে ইশারা করে তাতে চুমু প্রদান করা (৭) হাজরে আসওয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠানো (৮) তাওয়াফের শুরুতে হাজরে আসওয়াদের দিকে মুখ করা (৯) চক্করগুলো বিরতি না দিয়ে পরপর করা।

সায়ী

সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়ানোকে ‘সায়ী’ বলে। বর্তমানে এ স্থানটুকুর কিছু অংশ সবুজ পিলার দ্বারা চিহ্নিত আছে। সেখানে এসে দ্রুত দৌড়াতে হয়। সায়ী করা ওয়াজিব এবং তাওয়াফ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই এটা করা সুন্নাত। সায়ীর ওয়াজিবগুলো : (১) হেঁটে হেঁটে সায়ী করা (২) সাত চক্কর পূর্ণ করা (৩) সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থান পরিপূর্ণভাবে অতিক্রম করা। সায়ীর সুন্নাতগুলো : (১) হাজরে আসওয়াদে চুমু দিয়ে সায়ীর জন্য বের হওয়া (২) তাওয়াফ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সায়ী করা (৩) সাফা ও মারওয়ায় আরোহণ করা (৪) সাফা ও মারওয়ায় আরোহণ করে কেবলামুখী হওয়া (৫) সায়ীর চক্করগুলো একটির পর একটি আদায় করা (৬) সবুজ স্তম্ভ দুটির মধ্যবর্তী স্থানটি একটু দৌড়ে অতিক্রম করা।

উমরাহ

নিয়ত : ‘হে আল্লাহ! আমি উমরাহ পালন করার নিয়ত করছি, আমার জন্য তা সহজ করে দিন ও কবুল করুন।

উমরাহর ফরজ দুটি : ১. ইহরাম বাঁধা। ২. তাওয়াফ করা। উমরাহর ওয়াজিব দুটি : ১. সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে সাতবার সায়ী করা। ২. মাথার চুল মুণ্ডন করা।

হজ তিন প্রকার

হজে তামাত্তু : হজের মাসগুলোয় উমরাহর ইহরাম বেঁধে প্রথমে উমরাহ পালন করে ইহরাম খুলে ফেলা, অতঃপর হজের জন্য আবার ইহরাম বেঁধে হজ সমাপন করাকে ‘তামাত্তু হজ’ বলে। তামাত্তু হজে দমে শোকর বা হজের শোকরিয়া স্বরূপ কুরবানি করা ওয়াজিব।

হজে কিরান : হজের মাসগুলোয় উমরাহ ও হজ একসঙ্গে উভয়টির ইহরাম বেঁধে প্রথমে উমরাহ পালন করে ইহরাম না খুলে ওই একই ইহরামে হজ সমাপন করাকে ‘হজে কিরান’ বলে। কিরান হজে দমে শোকর বা হজের শোকরিয়া স্বরূপ কুরবানি করা ওয়াজিব।

হজে ইফরাদ : হজের মাসগুলোয় শুধু হজের ইহরাম বেঁধে হজ সমাপন করাকে ‘হজে ইফরাদ’ বলে। এতে কোনো উমরাহ পালন করা হয় না। ইফরাদ হজে দমে শোকর বা হজের শোকরিয়া স্বরূপ কুরবানি করা মুস্তাহাব।

হজের ফরজ

১. ইহরাম বাঁধা। ২. আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা অর্থাৎ ৯ জিলহজের সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে কোনো সময় এক মুহূর্তের জন্য হলেও আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। ৩. তাওয়াফে জিয়ারাহ করা অর্থাৎ ১০ জিলহজের ভোর থেকে ১২ জিলহজের সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাইতুল্লাহ শরিফের তাওয়াফ করা।

হজের ওয়াজিব

(১) নির্দিষ্ট জায়গা থেকে ইহরাম বাঁধা (২) সায়ী অর্থাৎ সাফা ও মারওয়ার মধ্যে দৌড়ানো। (৩) সাফা থেকে সায়ী শুরু করা। (৪) তাওয়াফের পর সায়ী করা (৫) সূর্যাস্ত পর্যন্ত উকুফে আরাফা করা। (৬) মুজদালিফায় উকুফ বা অবস্থান করা। (৭) মাগরিব এবং এশার নামাজ মুজদালিফায় এসে একত্রে এশার সময় পড়া। (৮) দশ তারিখ শুধু জামরাতুল আকাবায় এবং ১১ ও ১২ তারিখে তিন জামরায় রামি-পাথর নিক্ষেপ করা।

(৯) জামরাতুল আকাবার ‘রামি’ বা পাথর নিক্ষেপ দশ তারিখে হলক অর্থাৎ মস্তক মুণ্ডনের আগে করা (১০) কুরবানির পর মাথা কামানো কিংবা চুল ছাঁটা (১১) কিরান এবং তামাত্তু হজ পালনকারীর জন্য কুরবানি করা (১২) তাওয়াফ হাতিমের বাইরে দিয়ে করা (১৩) তাওয়াফ ডান দিক থেকে করা (১৪) কঠিন অসুবিধা না থাকলে হেঁটে তাওয়াফ করা (১৫) ওজুর সঙ্গে তাওয়াফ করা (১৬) তাওয়াফের পর দুরাকাত নামাজ পড়া (১৭) তাওয়াফের সময় সতর ঢাকা থাকা (১৮) পাথর নিক্ষেপ করা ও কুরবানি করা, মাথা মুণ্ডানো এবং তাওয়াফ করার মধ্যে তারতিব বা ক্রম বজায় রাখা (১৯) মিকাতের বাইরে অবস্থানকারীদের বিদায়ী তাওয়াফ করা (২০) ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো না করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *