ইসলামে অন্যের সাথে কথা বলার আদব
এস.এইচ.এম. আব্দুল কাদের,
অন্যের সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে ইসলাম কিছু বিধিমালা প্রণয়ন করেছে যেগুলো একজন মুসলিমের মেনে চলা উচিত, সর্বদা এই দৃঢ়চিত্ত বিশ্বাস রাখা উচিত যে সে যা কিছু বলে তার জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে এবং ভালো কথার জন্য সে পুরস্কৃত হবে ও মন্দ কথার জন্য শাস্তি পাবে।
সূরা ক্বাফের ১৮ নং আয়াতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন যার অর্থটা এরকম, “(ক্ষুদ্র) একটি শব্দও সে উচ্চারণ করে না, যা সংরক্ষণ করার …জন্য একজন সদা সতর্ক প্রহরী তার পাশে নিয়োজিত থাকে না।”
রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে সতর্ক করেছেন এই বলে যে কথা খুবই বিপজ্জনক। তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহর রেওয়াতে বর্ণিত একটি সহীহ্ হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “একজন ব্যক্তি এমন কোন কথা বলতে পারে যা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়, এবং সে এই বিষয়ে খুব একটা চিন্তা করে না কিন্তু আল্লাহ্ সুবহানাওয়া তা’আলা সেটার গুরুত্ব দেন আর সেই কথার জন্য শেষ বিচারের দিনে তার ওপর সন্তুষ্ট হন। এবং একজন ব্যক্তি এমন কোন কথা বলে যে সেটা আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয় কিন্তু সে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয় না কিন্তু আল্লাহ্ সুবহানাওয়া তা’আলা শেষ বিচারের দিবসে তার প্রতি ক্রোধান্বিত হবেন।”
কথাবার্তা বিপজ্জনক হতে পারে। তাই আমরা সেটা ইসলামিক বিধিমালা, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পথনির্দেশনা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হব। কথাবার্তা নিয়ন্ত্রণ করার কিছু উপায় নিচে বর্ণিত হলঃ
১. আপনার কথা বলার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মহৎ ও উপকারী। যদি আপনি ভালো কথা বলতে অক্ষম হন, তাহলে আপনার উচিত মৌনতা অবলম্বন করা, কারণ এটা আপনার জন্য মঙ্গলজনক। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের রেওয়াতে বর্ণিত একটি সহীহ্ হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও শেষ বিচারের দিবসে বিশ্বাস করে, তার উচিত উত্তম কথা বলা অথবা নীরব থাকা।”
২. সত্যবাদী হতে সচেষ্ট হোন এবং মিথ্যা বলা হতে বিরত থাকুন কারণ মুমিন সর্বদাই সত্যবাদী এবং এমনকি মজা করার ছলেও মিথ্যার আশ্রয় নেয় না। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “তোমরা অবশ্যই সত্য কথা বলবে কেননা সত্য সততার দিকে পরিচালিত করে এবং সততা জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বলে এবং সত্য ধারণ করে, আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসেবে পরিগণিত হয়। মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকো কেননা মিথ্যা মন্দের দিকে পরিচালিত করে আর মন্দ নিয়ে যায় জাহান্নামের পথে। যে ব্যক্তি অবিরাম মিথ্যা বলতে থাকে ও মিথ্যা বলার নিয়ত করে, আল্লাহর নিকট সে একজন মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিগণিত হয়।”
৩. মজাচ্ছলে কথা বলার সময় সতর্ক থাকুন, মজাচ্ছলে কিংবা একনিষ্ঠভাবে আপনার কথার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি অবাধ্য হওয়া থেকে বিরত থাকুন কারণ আল্লাহ্ অবাধ্যকারী, অভিশাপকারীকে ঘৃণা করেন। অবাধ্য কথাবার্তা হল সেই ধরনের কথাবার্তা যেগুলো আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা প্রকাশ করে, এবং অভিশপ্ত কথাবার্তা হল অন্যকে অভিশাপ দেওয়া, পাত্তা না দেওয়া এবং গালমন্দ করা। এই কারণে রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে সতর্ক করেছেন তাঁর একটি সহীহ্ হাদীসে এই বলেঃ “মুমিন ব্যক্তি কাউকে দোষারোপ করে না, অভিশাপ দেয় না, আল্লাহর অবাধ্য হয় না কিংবা অন্যকে গালমন্দ করে না।”
আরেকটি সহীহ্ হাদীসে তিনি বলেনঃ “একজন মুসলিমের জন্য অভিশাপ প্রদান করা হচ্ছে অবাধ্যতার শামিল।” মৃত ব্যক্তির প্রতি অভিশাপ প্রদান যেমন নিষিদ্ধ তেমনি জীবিতদের প্রতি অভিসম্পাত করাও নিষিদ্ধ। রাসূল (সাঃ) আমাদের নিষেধ করেছেন এই বলেঃ “মৃতদের প্রতি অভিসম্পাত করো না, কেননা তারা তাদের পার্থিব কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে।”আরেকটি সহীহ্ হাদীসে তিনি (সাঃ) আমাদের নিষেধ করেছেন এই বলেঃ “মৃতদের সম্বন্ধে সর্বদা উত্তম কথা বলো।”
৪. গীবাহ্ তথা পরনিন্দা (কারো অনুপস্থিতিতে তার সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যা তার উপস্থিতিতে বললে সে আঘাতপ্রাপ্ত হয়) হতে বিরত থাকুন এবং একজন অপরজনের বিরুদ্ধে গীবত করবেন না। নামিমাহ্(এটি হল মানুষের মধ্যে একজন আরেকজনের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার নিমিত্তে কথাবার্তা) হতেও বিরত থাকুন কেননা রাসূল (সাঃ) একটি সহীহ্ হাদীসে বলেনঃ “যে নামিমাহ্ চর্চা করে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” বাছবিচার না করেই যারা নামিমাহ্ ছড়ায় তাদের প্রতি কর্ণপাত করা হতেও বিরত থাকুন। কারণ, আপনি যদি তা করেন, তাহলে আপনিও তাদের গুনাহর অংশীদার হবেন।
৫. প্রয়োজন ব্যতীত কসম করা হতে বিরত থাকুন। আল্লাহ্ সুবহানাওয়াতা’আলা বলেনঃ “তোমরা তোমাদের (এমন) শপথের জন্য আল্লাহর নামকে কখনো ঢাল হিসেবে ব্যবহার করো না।” (সূরা বাকারাঃ২২৪)
৬. আপনার জ্ঞানসীমা ও দক্ষতার নিরিখে কথাবার্তা বলুন এবং যা আপনি জানেন না সেই বিষয়ে কথা বলবেন না। আল্লাহ্ বলেনঃ “যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, (অযথা) তার পেছনে পড়ো না।”(সূরা আল-ইসরাঃ৩৬)
৭.নিশ্চিত হয়ে কথা বলুন যাচাই-বাছাই ও নিশ্চয়তা ব্যতীত কারো সাথে যা শোনেন তা বলবেন না, কারণ আপনি অন্যদের কাছ থেকে সত্য ও মিথ্যা এবং সত্য ও সন্দেহযুক্ত কথাবার্তা শুনতে পারেন। যদি আপনি যা শোনেন তাই বলে বেড়ান, তাহলে আপনি গুনাহ এর ভাগীদার হবেন। সহীহ হাদীসে রাসূল (সাঃ) আমাদের সতর্ক করেছেন এইভাবেঃ “কোনো ব্যক্তির জন্য গুনাহ্ করার জন্য এটা যথেষ্ট যে সে যা শোনে, তাই প্রচার করে।”
৮.কথা বলার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করুন অন্যের সাথে কথা বলার সময় এটা নিশ্চিত করুন যে আপনার কথা বলার উদ্দেশ্য হয় যেন সত্যে পৌঁছা ও মিথ্যা প্রকাশ করা। এবং আপনার বা অন্য কারোর মাধ্যমে সত্য পৌঁছল কিনা কিংবা মিথ্যা প্রকাশিত হল কিনা সেই ব্যাপারে উৎসাহী হবেন না।
৯.অপ্রয়োজনীয় তর্ক (যার মুখ্য উদ্দেশ্যই থাকে অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করা কিংবা অন্যের ওপর জয়লাভ করা) জড়িত হওয়া হতে বিরত থাকুন। কারণ উদ্দেশ্যহীনভাবে তার্কিক হওয়া বিপথগামীতার লক্ষণ (আমরা আল্লাহর নিকট এর থেকে পানাহ্ চাই)। এই কারণে তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত একটি সহীহ্ হাদীসে রাসূল (সাঃ)আমাদের সতর্ক করেছেন এই বলেঃ “আল্লাহর পক্ষ হতে হিদায়াত পাওয়া সত্ত্বেও তারা পথভ্রষ্ট হয়েছিল, কেননা তারা অযথা তর্কে জড়িত হত।”
অযথা তর্ক করা পরিহার করুন যদিও সত্য আপনার পক্ষে থাকে। ইমাম আবু দাউদ কর্তৃক বর্ণিত আরেকটি সহীহ্ হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাত পরিবেষ্টিত একটি গৃহের নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে সঠিক হওয়া সত্ত্বেও অকারণ বিতর্কে লিপ্ত হয় না।”
১০.আপনার বক্তব্য সুস্পষ্ট ও প্রাঞ্জল করুন এবং বুঝতে অসুবিধা হয় এমন শব্দমুক্ত করুন ও অপ্রয়োজনীয় বাকপটুতা পরিহার করুন এবং অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করে এমন কিছু বলবেন না কেননা রাসূল (সাঃ) এই ধরনের কথাবার্তা বলা ঘৃণা করতেন। তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “সেই সকল লোকদের আমি চরম ঘৃণা করি ও কিয়ামত দিবসে তারা আমার নিকট হতে সর্বাপেক্ষা দূরে থাকবে, যারা অপ্রয়োজনে কথা বলে ও অন্যদের হেয় প্রতিপন্ন করে এবং কথা বলার সময় যারা লোকপ্রদর্শনী করে।”
১১.আপনার বক্তব্য ধীরস্থির, স্পষ্ট, শ্রুতিযোগ্য ও অন্যের নিকট বোধগম্যময় করুন। রাসূল (সাঃ) শব্দাবলী তিনবার করে পুনরাবৃত্তি করতেন এটা নিশ্চিত করার জন্য যে তা বোধগম্য হয়ও তাঁর বক্তব্য ছিল সহজ যাতে করে সবাই বুঝত।
১২.অত্যধিক ঠাট্টা করবেন নাঃ কথা বলার সময় আন্তরিক হোন এবং অত্যধিক ঠাট্টা করবেন না, আর যদিও করেন তবে রাসূল (সাঃ) এর অনুরূপ সত্যবাদী হবেন।
১৩. কারো কথা বলার সময় তাকে বাধাগ্রস্ত করবেন না ও তার বক্তব্য সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত শুনতে থাকুন এবং পরবর্তীতে তার বক্তব্যের ভালো ও উপকারী দিক সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করতে পারেন, এমন নয় যে আপনি অযথা উদ্দেশ্যহীনভাবে কথা বলবেন।
১৪. কথা বলুন ও বিতর্ক করুন সুন্দরভাবে যা কিনা অন্যের প্রতি ক্ষতি, আঘাত, হেয়-প্রতিপন্নতা ও উপহাস প্রদর্শন বর্জিত হয়। এই ধরনের কথা বলা সকল আম্বিয়া-রসূল কর্তৃক আদেশ করা হয়েছে। মূসা (আঃ) ও তাঁর ভাই হারূন (আঃ) কে ফেরাউনের নিকট প্রেরণের সময় আল্লাহ্ বলেছিলেনঃ “(হেদায়াত পেশ করার সময়) তোমরা তার সাথে নম্রভাবে কথা বলবে, হতে পারে সে তোমাদের উপদেশ কবুল করবে অথবা সে আমায় (ভয়) করবে।”(সূরা ত্বাহাঃ৪৪)
সুতরাং আপনি মূসা আলাইহি সালাম কিংবা হারূন (আলাইহি সালাম) অপেক্ষা উন্নত নন কিংবা যার সাথে আপনি কথা বলছেন সে ফেরাউন অপেক্ষা নিকৃষ্টতর।
১৫. কারো বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে বর্জন করবেন না শুধুমাত্র এই কারণে যে আপনি তার বক্তব্যে সঠিক ও ভুল এবং সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ খুঁজে পেয়েছেন, কেননা সত্য বর্জন করা উচিত নয় এমনকি যদি তা অন্য কিছুর সাথে মিশ্রিত থাকে যা স্বতন্ত্রভাবে স্বাধীন। সত্য বর্জন করা উচিত নয় এমনকি যদি তা মিথ্যার সাথে মিশ্রিত অবস্থায়ও বলা হয়। আপনি সত্য ও যথার্থ বক্তব্য গ্রহণ করবেন এবং কেবলমাত্র মন্দ ও মিথ্যাটুকু বর্জন করবেন আর এটাই হল আল্লাহ্ কর্তৃক আমাদের প্রতি ন্যায্য আদেশ।
১৬.অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকে দূরে থাকুন লোকের সামনে নিজেকে পরিপূরক কিংবা সিদ্ধান্তে অটল হিসেবে উপস্থাপন করবেন না, কেননা এটা হল ঔদ্ধত্যের ফল যা আল্লাহ্ সুবহানাওয়া তা’আলা আমাদেরকে করতে নিষেধ করেছেন সূরা নাজমের ৩২ নং আয়াতের মাধ্যমে “অতএব তোমরা আত্নপ্রশংসা করো না। তিনি ভাল জানেন কে সংযমী”।