Home জীবনযাপন সৈয়দপুরের চিনি মসজিদ
মে ১৮, ২০২৩

সৈয়দপুরের চিনি মসজিদ

২৫ এপ্রিল ২০২৩ মঙ্গলবার। ঘড়ির কাঁটায় আনুমানিক রাত ৪টা। উত্তরের প্রাচীন জনপদ সৈয়দপুর শহর ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ি এসে থামল ইসবাগে। গাড়ি থেকে নামতে চোখ পড়ল সুন্দর কারুকার্যে ঘেরা সুরম্য এক মসজিদে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। কী অপরূপ মসজিদ। এক দেখাতেই যে কারও নজর কাড়বে এটি। সামনে এগিয়ে গেলাম। মূল ফটকের পাশের এক অংশে ফার্সি এবং বাংলায় বড় করে লেখা ‘চিনি মসজিদ ১৮৬৩’। ওজু শেষে মসজিদে প্রবেশ করলাম। ফজরের সালাত শেষে যখন বেরিয়ে আসি প্রকৃতি তখন বেশ ফর্সা হয়ে গেছে। কোমল স্নিগ্ধ বাতাস। আমরা একদল অভিভূত দর্শক, মুগ্ধ হয়ে দেখছি প্রায় পৌনে দুইশ বছরের পুরোনো এ স্থাপনা। নীলফামারী জেলা সদর থেকে ২০ কিমি. দূরে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার খুব কাছে ইসবাগ এলাকায় অবস্থিত এ ঐতিহাসিক চিনি মসজিদ। বাংলাদেশে যে কয়টি মসজিদ ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে পড়ে, চিনি মসজিদ তার মধ্যে অন্যতম। শৈল্পিক কারুকাজ ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য হিসাবে চিনি মসজিদের রয়েছে বিশেষ খ্যাতি। এ মসজিদে পাঁচ শতাধিক মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

১৮৬৩ সালে হাজি বাকের আলী ও হাজি মুকুল নামের স্থানীয় দুই বাসিন্দা সৈয়দপুর উপজেলা শহরের ইসবাগ এলাকায় বাঁশ ও কাঠ দিয়ে প্রথম এ মসজিদের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী সময়ে এলাকাবাসীর সহায়তায় মসজিদটিকে টিনের মসজিদে রূপান্তর করা হয়। এরপর এলাকার লোকজন মসজিদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন।

১৯২০ সালে হাফেজ আবদুল করিমের উদ্যোগে প্রথম মসজিদের প্রথম অংশ পাকা করা হয়। এ সময় মসজিদের দৈর্ঘ্য ছিল লম্বায় ৪০ ফুট ও প্রস্থে ৩৯ ফুট। ১৯৬৫ সালে মসজিদের দ্বিতীয় অংশ পাকা করা হয় এবং ১৯৮০-এর দশকে মসজিদের শেষ অংশ পাকা করা হয়। কারুকার্যের জন্য কলকাতা থেকে মর্মর পাথর ও চীনামাটির নকশা করা থালা আনা হয়। মসজিদের অধিকাংশ কারুকাজ চীনামাটির। মসজিদের নকশার কারিগরও কলকাতা থেকে আনা হয়েছিল। সৌন্দর্য বাড়াতে দেওয়ালে চীনামাটির থালা ও কাচের টুকরা বসানো হয়। এ পদ্ধতিকে ‘চিনি করা’ বা ‘চিনি দানার’ কাজ বলা হয়। ধারণা করা হয় এখান থেকেই এর নামকরণ হয় ‘চিনি মসজিদ’। আবার কেউ কেউ বলেন পুরো মসজিদে চীনামাটির কাজ রয়েছে। এ কারণেও এর নাম চিনি মসজিদ হতে পারে।

চিনি মসজিদ নির্মাণে মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করা হয়েছে। মসজিদের দেওয়ালে ফুলদানি, ফুলের তোড়া, গোলাপ ফুল, একটি বৃন্তে একটি ফুল, চাঁদ-তারাসহ নানা কারুকার্য অঙ্কিত করা আছে। মসজিদ তৈরিতে প্রচুর মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদটিতে ২৭টি বড় মিনার, ৩২টি ছোট মিনার ও তিনটি বড় গম্বুজ রয়েছে। দোতলা মসজিদে প্রবেশ পথের পাশে আজান দেওয়ার জন্য মিম্বার রয়েছে। মসজিদে ২৪২টি শঙ্কর মর্মর পাথর রয়েছে। মসজিদের বারান্দা সাদা মোজাইক পাথর দ্বারা আবৃত। মসজিদের সম্পূর্ণ অবয়ব রঙিন পাথরে মোড়ানো। মসজিদে প্রবেশের জন্য উত্তরে ও দক্ষিণে একটি করে প্রধান দরজা আছে। মসজিদের দোতলায় একটি ভবনসহ একটি মেহমানখানা আছে। সেখানে পর্যটকদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে মুঘল শাসক ও অন্যান্য মুসলিম নবাবদের হাতে নির্মিত অনেক মসজিদকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এটিই একমাত্র মসজিদ যা এলাকাবাসী ও সর্বসাধারণের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় নির্মিত হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।

এলাকাবাসীর মুখ থেকে মসজিদের এ সুদীর্ঘ ইতিহাস শুনতে শুনতে আমরা যেন ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিলাম। পুরো মসজিদ ঘুরে দেখলাম। কী চমৎকার স্থাপত্যশৈলী! ১৬০ বছর পরে এসেও তা ঠিক কতটা জীবন্ত! মুসলিম নিদর্শনের এ স্মৃতিফলকগুলো সগৌরবে বেঁচে থাকুক যুগ যুগান্তরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *