শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ নবিজি সা. আজ ইসলামি শিক্ষা বলতে কেবল কুরআন সুন্নাহর নির্দিষ্ট কিছু অংশের চর্চা বোঝানো হয়। অথচ সোনালি যুগে বিজ্ঞানচর্চা না করে আলেম হওয়ার সুযোগ ছিল না। ইসলামি শিক্ষার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন লন্ডনের নর্থহ্যাম্পটনে আল নূর ইসলামিক স্কুলের পরিচালক শায়খ মোহাম্মাদ সাইফুল আজম আল আজহারি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন-
জ্ঞান অর্জনে ইসলাম কী তাগিদ দিয়েছে? ইসলামের ভিত্তিই গড়ে উঠেছে জ্ঞানকে কেন্দ্র করে। আসলে এ ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। ধর্ম এসেছে মানুষের ভেতর জগৎ আলোকিত করার জন্য। ভেতর আলোকিত না হলে আপনি নানা ধর্মের নানা বর্ণের মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে পারবেন না। ধর্মের স্বার্থে মানুষের সঙ্গে মেশা জরুরি।
আবার মানুষের সঙ্গে মিশতে হলে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখার জন্য জ্ঞানের বিকল্প নেই। ইসলামের জ্ঞানের মর্যদা বোঝাতে আমি তিনটি উদাহরণ দেব। প্রথমত মানব সৃষ্টির সূচনাতে আল্লাহ আদম (আ.)কে সৃষ্টি করে তার শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হিসাবে জ্ঞানকে হাইলাইট করেছেন। আল্লাহ কিন্তু বলেননি, আদম দেখতে সুন্দর। তার স্মার্ট পোশাক অথবা আরও অনেক বিষয় ছিল যেগুলো হাইলাইট করা যেত। কিন্তু আল্লাহ বললেন, ‘ওয়াআল্লামা আদামাল আসমাআ কুল্লাহা।
আল্লাহতায়ালা আদমকে যাবতীয় জ্ঞান শিখিয়েছেন।’ অর্থাৎ, আদমের শ্রেষ্ঠত্ব হলো সে জ্ঞানী। দ্বিতীয়ত নুরনবি (সা.)-এর ওপর প্রথম যে ওহিয়ে এলাহি এসেছে সেটা কিন্তু ইমান, তাওহিদ, নামাজ, রোজা, আখিরাত, কেয়ামত সম্পর্কে নয়, এসেছে জ্ঞান সম্পর্কে। ‘ইকরা’, পড়! আশ্চর্যের কথা হলো, প্রথম ওহির পাঁচ আয়াতের চারটিই পড়া সম্পর্কে। প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, পড় তোমার প্রভুর নামে। তৃতীয় আয়াতে আবার বলা হচ্ছে, পড়! তোমার প্রভু দয়াময়। চতুর্থ আয়াতেও বলা হয়েছে, তিনি তোমাকে কলম দিয়ে শিখিয়েছেন।
পঞ্চম আয়াতে আবার জ্ঞানের প্রসঙ্গ টেনে আল্লাহ বলছেন, তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানত না। আরেকটু গভীরে গেলে দেখবেন, এখানে আল্লাহ শুধু জ্ঞান নয় জ্ঞান সংরক্ষণের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়েছেন। পড়ার নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ পড়ানোর বা শেখানোর মাধ্যম কলমের উল্লেখ করেছেন এ জন্যই। আমরা যদি হুজুর (সা.)-এর জীবনী বিশ্লেষণ করি, সেখানেও তিনি এ দুটি বিষয়ে সাহাবিদের খুব বেশি উৎসাহ দিয়েছেন।
তিনি সাহাবিদের জ্ঞান শিখিয়েছেন, আবার তা সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করেছেন। শুরুর দিকে হুজুর (সা.) হাদিস লিখতে নিষেধ করেছেন কুরআনের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আশঙ্কায়। কিন্তু তিনি সাহাবিদের নির্দেশ দিয়েছেন, আপাতত হাদিস লিখ না, তবে ব্যাপক আকারে প্রচার করতে থাক।
জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারে রাসূল (সা.) কী কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
হুজুর করিম (সা.) শিক্ষার ওপর অনেক জোর দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি কয়েকজন সাহাবিকে স্পেশাল ট্রেনিং দিয়ে তাদের শিক্ষক হিসাবে গড়ে তুলেছেন। এ সাহাবিরা অন্যদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। বদরের যুদ্ধের দিকে তাকালে বুঝতে পারব শিক্ষার ব্যাপারে হুজুর কত গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা যদি ফতহুল বুলদান দেখি, সেখানে বলা হয়েছে মক্কায় তৎকালীন পনেরো হাজার মানুষের মধ্যে মাত্র পনেরোজন লিখতে ও পড়তে জানতেন।
এটাকে যদি আমরা ত্রিশ হাজার এবং লিখতে পড়তে জানা মানুষের সংখ্যা একশজনও ধরে নিই তবুও শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো হবে না। তো বদরের যুদ্ধে যখন মক্কার কাফের মুশরিকরা যুদ্ধবন্দি হলো, তাদের মধ্যে কিছু শিক্ষিত মানুষও ছিল। তখন নবি (সা.) একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ নিলেন। এ উদ্যোগের নাম আমি দিয়েছি, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম শিক্ষা আন্দোলন।’ নবি বললেন, হে যুদ্ধবন্দিরা! তোমাদের মধ্যে যারা লিখতে পড়তে জান, তারা যদি মদিনার দশজন বালককে লিখতে পড়তে শেখাতে পার তাহলে তোমাদের মুক্ত করে দেওয়া হবে। হুজুর (সা.) শিক্ষাকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন বলেই ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হজরত ফারুকে আজমের শাসনকালে সাক্ষরতার হার শতভাগ হয়ে যায়।
ইসলাম কি দ্বীনি ইলম ও দুনিয়াবি ইলম নামে জ্ঞানের বিভাজন করেছে?
ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ধর্ম এ দুটির বিভাজন মুছে দিয়েছে। আরবি দ্বীন শব্দকে বাংলায় ধর্ম বলা হয়। আসলে দ্বীন শব্দের সঠিক সমার্থক শব্দ বাংলায় নেই। একইভাবে ইংরেজি রিলিজিয়ন শব্দটিও দ্বীন শব্দের ব্যাপকতা ধারণ করতে পারে না।
ধর্ম ও রিলিজিয়নের আরবি হলো মাজহাব, দ্বীন নয়। আপনি যদি অক্সফোর্ড দেখেন সেখানে বলা আছে, রিলিজিয়ন হলো কিছু প্রথা, নিয়ম কানুন ও নৈতিক শিক্ষা। আমাদের দ্বীনের একটা অংশ হলো ওয়ারশিপ বা ইবাদত এবং নৈতিকতা। কিন্তু দ্বীন বলতে আরও বিস্তৃত বিষয়কে বোঝায়। মানব জীবনের যত দিক ও বিভাগ আছে সবকিছু এর অন্তর্ভুক্ত। এবং প্রতিটি দিক ও বিভাগের জন্য একটি সমাধান দ্বীনে রয়েছে। এখন আমার কাছে ধর্ম শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ না থাকায় দ্বীনের তরজমায় ধর্ম বলতে বাধ্য হয়েছি।
আমি যখন বলি ধর্মের আলোকে রাজনীতি করতে হবে, তখন আধুনিক শিক্ষিতরা বলেন, ধর্ম কেন রাজনীতিতে আসবে? এক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের কথা ঠিক, ধর্ম তো রাজনীতিতে আসার কথা নয়। ধর্ম আসবে ইবাদত, প্রথা, নৈতিকতা প্রসঙ্গে। কিন্তু দ্বীন বললেই আপনি ক্লিয়ার হয়ে যাবেন এটি শুধু ইবাদত বা নৈতিকতার এক বা দুটি দিক নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয় নয়। আপনার পুরো জীবন দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। এবার আপনার প্রশ্নের উত্তরে আসি। ইসলামপূর্ব সময়ে বিজ্ঞান ও ধর্মের মাঝে একটি বিরোধ ছিল। বিজ্ঞান ধর্মকে মেনে নিতে পারত না, আবার ধর্মও বিজ্ঞানকে সহ্য করতে পারত না। কুরআন এসে দীর্ঘদিনের এ দ্বন্দ্ব দূর করে দিয়েছে।
একটি উদাহরণ দিন
আল্লাহতায়ালা ধর্ম ও বিজ্ঞানকে একটি আয়াতের মাধ্যমে সমান উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। আমি এখনো ‘ধর্ম’ শব্দটিই বলে যাচ্ছি কারণ এর অন্য কোনো বাংলা প্রতিশব্দ আমাদের কাছে নেই।
সূরা আলে ইমরানের ১৯১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যারা দাঁড়িয়ে বসে ও শুয়ে আল্লাহর জিকির করে’-আয়াতের প্রথম অংশ এটি। এখানে জিকরে ইলাহির কথা বলা হয়েছে। এটা দ্বীন। পরের অংশ দেখুন, ‘এবং তারা পৃথিবী ও মহাশূন্য নিয়ে চিন্তা গবেষণায় মগ্ন।’ এটা বিজ্ঞান। আয়াতের উপসংহারে আল্লাহ বলেছেন, ‘এই দুই শ্রেণিই বলে, হে আল্লাহ! আপনি কোনো কিছুই খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেননি। আপনি মহাপবিত্র। আমাদের আগুনের শাস্তি থেকে বাঁচান।’
খেয়াল করুন, জিকরে এলাহি এবং বিজ্ঞানকে আল্লাহ একটি আয়াতে উল্লেখ করে ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিরোধ মিটিয়ে দিয়েছেন। আমাদের বুঝতে হবে ধর্মের আলোচ্য বিষয় আর বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। কেউ যদি বলে, গাড়ি আর প্লেনের সংঘর্ষ হয়েছে, এ দাবির কোনো ভিত্তি নেই। দুটির চলার পথ দুরকম। এখন আসুন বাংলা ধর্ম বা আরবি মাজহাব কী করে?
মাজহাব শুধু জিকরে এলাহির বিষয় আলোচনা করে। কিন্তু দ্বীন ধর্ম ও বিজ্ঞানসহ গোটা জীবন ব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর ফলে মানুষ বুঝতে পারে, মহাবিশ্বের কোনো কিছুই আল্লাহ খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেননি। গত তেরোশ বছরের ইতিহাসে ইসলামে জ্ঞানের কোনো বিভাজন ছিল না। আমাদের যিনি মুফাসসির ছিলেন, তিনি আবার কেমিস্ট-বায়োলোজিস্টও ছিলেন। পৃথিবীর আর কোনো ধর্মের স্কলাররা এত বহুমুখী বিদ্যায় পারদর্শী ছিল বলে আপনি দেখাতে পারবেন না।
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) ফিকহ, ইসলামি আইন, দর্শন, রসায়ন, পদার্থ, জীববিজ্ঞান, তাসাওউফ সব শাখায় বুৎপত্তি লাভ করেন। এ থেকেই বোঝা যায়, ইসলাম জ্ঞানের বিভাজন করেনি।